• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অহেতুক খারাপ ধারণা ইসলামে নিষিদ্ধ


নাঈম কাসেমী জুন ২৪, ২০২১, ০১:২০ এএম
অহেতুক খারাপ ধারণা ইসলামে নিষিদ্ধ

ঢাকা : আমরা কারো প্রতি ক্ষুব্ধ হলে, কাউকে প্রতিপক্ষ মনে করলে, তাকে নিজের স্বার্থের প্রতিকূল মনে করলে, তাকে ঘায়েল করার পথ খুঁজি। ছুতা-নাতার অপেক্ষায় থাকি তাকে সাইজ করা জন্য। রাষ্ট্রে, সমাজে, পরিবারে, অফিসে, ব্যবসায় সর্বক্ষেত্রেই এই প্রবণতা ও মানিসকতা বিরাজমান। বিশেষকরে অধীনদের, সহকর্মীদের কোনো কোনো কাজ পছন্দ না হলে, তাকে দিয়ে নিজের মনগড়া সবকিছু বাস্তবায়ন করাতে না পারলে, আসতে-যেতে জি-হুজুরগিরি না করলে, নিজের অন্ধ সাপোর্টার না হলে আমরা তার প্রতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষুব্ধ হই এবং তাকে পথের কাঁটা মনে করে সরাতে কিংবা ঘায়েল করতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। আর সে পা ফসকে ছোটখাট কোনো ভুল করে ফেললেতো আর কোনো কথাই নেই! তিলকে তাল বানিয়ে কারণ দাঁড় করিয়ে কুপোকাত করি অথবা কোণঠাসা করে রাখি।

কেউ প্রচলিত নিয়ম বা অফিসিয়াল রুল ভঙ্গ না করলেও শুধু নিজের অপছন্দীয় হওয়ার কারণে, নিজেকে অন্ধভাবে সাপোর্ট না দেওয়ার কারণে ছুতানাতা ধরে, ধারণার ভিত্তিতে অভিযুক্ত করে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া, তার জবানবন্দি গ্রহণ ছাড়া, কোনো রকমের কৈফিয়ত তলব করা ছাড়া তার বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেও অনেক ক্ষেত্রে একটুও দ্বিধা করি না আমরা। শুধু অনুমানের ভিত্তিতে, যে কোনোভাবেই ঘটনা পরস্পরায় মিল থাকার কারণ, আগে কোনো বিষয়ে ভিন্নমত দেওয়ার কারণে সেটার ওপর অনুমান করে পরবর্তীতে সংঘটিত নেতিবাচক যে কোনো কিছুই তারই কাজ- এমন সিদ্ধান্ত দাঁড় করাই। এগুলোর অধিকাংশই আমরা করি ইচ্ছাকৃতভাবে।

পক্ষান্তরে যার প্রতি অন্ধ অনুগ্রহ থাকে তার জি হুজুরগিরি কিংবা ব্যক্তিগত কোনো দুর্বলতার কারণে তার বেলায় আমরা প্রমাণিত অপরাধকেও এডিয়ে যাই ভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে। তাকে সাপোর্ট করি। কোনো বিষয়ে ধারণা করারও একটা পর্যায় থাকে। ধারণাটা কতটা করা যাবে, সেটার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট গাইড লাইন রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ, অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত-১২) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরস্পরের প্রতি অহেতুক ধারণা করা থেকে বিরত থাকতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমরা অহেতুক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা অহেতুক ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা।’ (বুখারি ও মুসলিম)

যেখানে ইসলামে কারো ব্যাপারে ধারণা করার ক্ষেত্রেই এতোটা সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য বলা হয়েছে, যেখানে শুধুই এমন ধারণার ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্তে আসা, ক্ষমতা আছে বলে ব্যক্তিকে শুধুই আন্দাজের ভিত্তিতে একতরফা দায়ী করে কাউকে যে কোনো শাস্তি দেওয়া হলে সেটা ন্যায়-ইনসাফ হবে? ন্যায়বিচার হবে? কখনোই না। অমুক এই কাজটি করে থাকতে পারে, কাজটি তারই, সে ছাড়া এটি আর কে করবে, সে আগে এ ব্যাপারে এমন মনোভাব পোষণ করতো, সেই এসব বিষয় বেশি জানে, তাই এটি তার কাজ ছাড়া আর কারো কাজ নয়; এমন মনোভাবে কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করে তার ব্যাপারে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ ইসলাম অনুমাদন করে না। যে বিষয়ে প্রকাশ্য কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই, সেটি ব্যক্তির জন্য গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়। সেই গায়েব আল্লাহতায়ালা ছাড়া আর কেউ জানার কোনো সুযোগ নেই। গায়েবকে বাস্তবজ্ঞান করে কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করাটা আল্লাহর সাথে শিরক করার শামিল। আর শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলুম।

আসলে উদ্দেশ্যেটা যখন কাউকে ঘায়েল করা হয় তখন প্রকৃত বিচার-আচার ও সঠিক নিয়ম অনুসরণের বিষয়গুলো গৌণ হয়ে যায়। যেনতেনভাবে লক্ষ্যবস্তুকে ঘায়েল করাটাই উদ্দেশ্য থাকে। অভিযোগ ও বিচারের প্রলেপটা তখন আসলে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কৌশল মাত্র। আর এভাবে কাউকে ঘায়েল করা মানেই তার ওপর জুলুম করা। যে ঘায়েলের শিকার হয় সে মজলুম। হ্যাঁ, আদালতের বিচারকের ক্ষেত্রে যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের পর সবার বক্তব্য শোনার পর তার ভিত্তিতে  নিজের বিবেক প্রয়োগ করে রায় দেওয়াটা গ্রহণযোগ্য। সেটা বিচারকগণ দিয়ে থাকেন। তারপরও সেটার ভুল শোধরানোর জন্য পরবর্তীতে আরো দুই তিনস্তরের আপীল, রিভিউ ইত্যাদির পথ খোলা রাখা হয়।

বিচার বিচারই। কারো বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগের বিচার করা আর কারো বিরুদ্ধে মানহানি, শৃংখলাভঙ্গ, অসদাচণের বিচার-সকল বিচারের পদ্ধতি ও নিয়ম একই। খুনের ঘটনা মানুষের সামনে বেশি গুরুত্ব পায় বলে ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করলে মানুষের চোখে ধরা পড়ে। ছোটখাট বিচারের বিষয়গুলো মানুষ সেভাবে গুরুত্ব দেয় না বলে সামনে আসেনা। পরিবার, প্রতিষ্ঠানের বিষয়গুলোতে বাইরের লোকের জানারও সুযোগ হয়না। তাই বলে আপনি আপনার ব্যক্তিগত ক্রোধ, ক্ষোভ, পছন্দ-অছন্দের কারণে তাকে ঘায়েল করার মানসে তাকে বিচারের নামে শাস্তি দিয়ে দিতে পারেন। এটি কোনো মুমিন করতে পারেনা। বিষয়টি কেউ না দেখলেও মহান রাব্বুল আলামীন দেখছেন। তাকে ভয় করলে তার দেখানো পথ কিংবা দুনিয়ার প্রচলিত নিয়ম লংঘন করে এভাবে আপনি অপরকে ঘায়েলের কৌশল অবলম্বন করতে পারেন না।

প্রচলিত কিংবা ইসলামী কোনো আইনেই শুধু ধারণা বা অনুমান করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। দোষী সাব্যস্ত করে তার বিচার বা তাকে শাস্তি দেওয়া যায় না। কেউ প্রকাশ্য অপরাধ করার পরও বিচারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণ দলিল উপস্থাপন, কিংবা স্বীকারোক্তি নিয়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে হয়। দোষী সাব্যস্ত করা না গেলে তাকে শাস্তি দেওয়া কোনো আইনেই অনুমোদন করে না। সেটা যেই ধরনের শাস্তি হোক না কেনো।

ইসলামে কোনো খবর যাচাই না করে বিশ্বাস ও প্রচারের কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি অনুমানের ভিত্তিতে কোথাও থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা খবরকে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই, ক্রস চেক ছাড়াই গ্রহণ করে নিয়ে সত্যজ্ঞান করে ফেলি; সেটি ইসলামসম্মত নয়। পবিত্র  কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ! কোনো পাপাচারী ব্যক্তি যদি তোমাদের কাছে কোনো খবর নিয়ে আসে তাহলে তোমরা তা যাচাই করে দেখবে। যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৬) কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ কেবল তখনই হয়, যদি তা অসতর্কতায় হয়। কিন্তু যেখানে খবর হচ্ছে ছুতামাত্র, সেখানে তো আর অনুতাপের কিছু নেই। সেখানে তো উদ্দেশ্যই হলো যে কোনো উপায়ে অপরের ক্ষতিসাধন। ইচ্ছাকৃতভাবে কারো ক্ষতি করা তো যায়ই না। অনিচ্ছায় ও অসতর্কতায় তা হতে পারে। সেজন্য সতর্কতা ও যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা বিনা অপরাধে ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৫৮)

যাচাই না করে কোনো সংবাদ বলে বেড়ানো বা শেয়ার করে প্রচার করা মিথ্যার শামিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যাই শুনবে (সত্যতা যাচাই না করে) তাই বর্ণনা করবে।’ (সহিহ মুসলিম) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে এমন দোষে দোষারোপ করবে, যা থেকে সে মুক্ত, আল্লাহ তাকে ‘রাদগাতুল খাবাল’ নামক জাহান্নামের (পুঁজ, রক্ত ও মলমূত্রের) গর্তে বাসস্থান করতে দেবেন, যতক্ষণ না সে অপবাদ থেকে ফিরে  আসে (অপবাদের প্রমাণ দিতে না পারে)।’ (আবু দাউদ)

কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে তথ্য যাচাই করতেই হবে। কারণ, ভুল তথ্যের ওপর নেওয়া সিদ্ধান্তও ভুল হবে এবং এর পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘শপথ সেই মহান সত্তার! যাঁর হাতে আমার প্রাণ। দুনিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংস হবে না (তার পূর্বে) মানুষের প্রতি এমন একসময় আসবে; হত্যাকারী জানবে না সে কেন হত্যা করছে, আর নিহত ব্যক্তি জানবে না তাকে কেন হত্যা করা হয়েছে। বলা হলো-সেটা কীভাবে হবে? বললেন, হারাজ (গুজব, হুজুগ, অলীকতা, বিবেকহীনতা, মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা, অন্যায় হত্যা, বিচারহীনতা ও সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ইত্যাদি) এর কারণে।’ (মুসলিম, হাদিস নং-৩৯০৮)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের আগে ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, ভূমিকম্প বেশি হবে, সময় সংকীর্ণ হয়ে যাবে, ফিতনা প্রকাশ হবে, হত্যাকাণ্ড-খুনখারাবি বেড়ে যাবে, সম্পদের আধিক্য হবে।’ (বুখারি, হাদিস নং-১০৩৬)। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! তখন কি মানুষের বুদ্ধুিবিবেক থাকবে না?’ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘না। সে সময় মানুষ বিবেকশূন্য হয়ে যাবে এবং মনে করবে সে-ই সঠিক, আসলে তা নয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-৪০৯)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের আলামত হলো ‘হারাজ’! বলা হলো ‘হারাজ’ কী? তিনি বললেন, ‘মিথ্যা ও হত্যা। এই হত্যা হবে অজ্ঞতাপ্রসূত, স্বার্থপরতায় এবং খামখেয়ালিপনায়।’ (ফাতহুল বারি, খণ্ড- ১৩, পৃষ্ঠা- ৩৪) আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে কারো প্রতি অযথা খারাপ ধারণা করা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

লেখক : পরিচালক, জামিয়া শায়খ আরশাদ মাদানী, সদর, ময়মনসিংহ

 

Wordbridge School
Link copied!