• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইখলাসবিহীন আমল মূল্যহীন


মুহাম্মাদ মাহদী হাসান জুলাই ২৬, ২০২১, ০২:০৭ পিএম
ইখলাসবিহীন আমল মূল্যহীন

ঢাকা : ইখলাস হলো মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মুসলমানদের একত্ববাদের বিশ্বাস ও আমলের প্রতিদানের যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা ইখলাসবিহীন সম্পূর্ণ বৃথাই পরিণত হবে। ইখলাস শব্দটি আরবী ‘আখলাসা’ শব্দ হতে নির্গত। এ শব্দের ‘মুজারে হলো, ‘ইউখলিসু’ আর এর মাছদার, ‘ইখলাসান’ অর্থাৎ নিরেট বা খাঁটি বস্তু; কোনো বস্তু নির্ভেজাল ও খাঁটি হওয়া এবং তার সাথে কোনো কিছুর সংমিশ্রণ না থাকাকে ইখলাস বলে। যেমন, বলা হয় ‘আখলাসার রাজুলু দ্বীনাহু লিল্লাহ’ অর্থাৎ, লোকটি তার দীনকে কেবল আল্লাহর জন্যই খাস করল। লোকটি তার দীনের বিষয়ে আল্লাহর সাথে কাউকে মিলায়-নি বা শরিক করেনি। মানবজাতি ও জীন জাতিকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনা করে মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ‘আমি মানবজাতি ও জীন জাতিকে সৃষ্টি করেছি, একমাত্র আমি (আল্লাহপাকের) ইবাদত করার জন্যে।’

মুফাসসিরগণ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় উম্মতকে বুঝানোর নিবৃত্তে প্রশ্ন করে বলেন। আমরা তো শারীরিক, পারিবারিক ও সামাজিক চাহিদা পূরণে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, আদায়ের পর জীবিকা নির্বাহের কাজে, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, ও কৃষি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকি, তাহলে কিভাবে আল্লাহতায়ালার ঘোষণার ওপর আমল করা সম্ভব হবে? অর্থাৎ (কেবলমাত্র আল্লাহপাকের ইবাদত করা কিভাবে সম্ভব?) প্রশ্নের সাথে সাথে মুফাসসিরিনে কেরামগণ, উত্তরে বলেন, বান্দার সব কাজকর্ম যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ অনুসারে, একনিষ্ঠতার সাথে, কেবলমাত্র আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হবে, তখন এসব কর্মকাণ্ড ইবাদতের মাঝে গণ্য করা হবে।

অপর দিকে যদি কোনো ব্যক্তি নিয়মিত নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাহসহ নফল আমলের নিয়মিত পাবন্দিও হয়। আর যদি ইখলাস না থাকে, তাহলে এসব আমলের কোনোটিই ইবাদত হিসাবে গণ্য করা হবে না। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আপনি বলুন-আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল।’ (সুরা আল-আনআম, আয়াত-১৬২, ১৬৩) আর আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত ব্যতীত দিনরাত একাকার করে যত আমলই করা হোক তাতে বিন্দুমাত্র প্রতিদানের আশাও করা যাবে না।

এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সমস্ত আমলই নিয়তের (বিশুদ্ধতার) ওপর নির্ভরশীল, মানুষের জন্য তাই রয়েছে, যা সে নিয়ত করে। সুতরাং যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে হয়, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যেই হয়েছে বলে পরিগণিত হবে। এবং যার হিজরত দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে হবে, অথবা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে, তাহলে হিজরত যে উদ্দেশ্যে করেছে, সেজন্যেই হয়েছে বলে পরিগণিত হবে।’ (বুখারি শরিফ) তাই আমল কবুল হওয়ার জন্য বিশুদ্ধ নিয়তের বিকল্প নেই। আর বিশুদ্ধ নিয়ত হলো যা কিছু করা একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার নিবৃত্তেই করা। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন-‘তাদেরকে এছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে।’ (সুরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত-৫)

নিয়তকে বিশুদ্ধ করে অল্প আমলই মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তুমি তোমার ঈমানকে বিশুদ্ধ করো, অল্প আমলই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।’ (আল-হাদিস) আল্লাহপাক মানবজাতিকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন, মানুষের আমলের পরীক্ষা করবার জন্যে, কে ইখলাসের সাথে আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে আমল করে? আর কে মানুষকে দেখানোর জন্য, বা দুনিয়া অর্জন করার নিবৃত্তে আমল করে? এজন্য মানুষকে দুনিয়াতে জীবন দান করেছেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন-‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ?’ (সুরা আল-মুলক, আয়াত-২)

মানুষকে ইবাদতের পথনির্দেশনা দিয়ে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারীম অবতীর্ণ করেছেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ অনুযায়ী একনিষ্ঠতার সাথে ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন-‘আমি আপনার প্রতি এ কিতাব যথার্থরূপে নাজিল করেছি। অতএব, আপনি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করুন। জেনে রাখুন, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহরই নিমিত্ত।’ (সুরা আয-জুমার, আয়াত-২, ৩)

ইখলাসবিহীন কেউ যদি দিনরাত একাকার করেও নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও কোরবানিসহ সব ধরনের ইবাদতে নিমগ্নও থাকে তথাপি সেসব ইবাদতসমূহের প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।’ (সুরা আল কাহাফ) আমাদের সমাজ ধনী-গরিব, সুন্দর-কালো, উঁচু-নীচু, শক্তিধর ও দুর্বলদের মাঝে তারতম্য করলেও, আল্লাহতায়ালার কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। আল্লাহতায়ালা কাছে কে ধনী কে গরিব, কে সুন্দর, কে কালো, কে উঁচু, কে নীচু, কে ক্ষমতাধর, কে ক্ষমতাধর নয়, এসবের কোনো মূল্য নেই। আল্লাহতায়ালা দেখেন, বান্দার অন্তরে কি রয়েছে। সুন্দর হওয়াতে যদি আল্লাহতায়ালার কাছে কোনো দাম থাকত, তাহলে হাবশি কালো বেলাল (রা.)-এর এতো মর্যাদা হতোনা। অথচ; রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজের রজনীতে জান্নাতে হজরত বেলাল (রা.)-এর পায়ের (চলাচলের) আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন।

হজরত বেলাল (রা.)-এর এই মর্যাদা অন্য কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়। এই মর্যাদা হজরত বেলাল (রা.)-এর ঈমান-আমল ও ইখলাসের বিনিময়ে হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহপাক তোমাদের শরীর ও অবয়বের দিকে তাকান না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকান করেন।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং- ২৫৬৪)

আল্লাহপাক কোরআন কারীমে বলেন; আমি ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টির জন্য তারা যেসব আমল করবে, আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব, অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণা করে দেব।’ (সুরাহ ফুরকান, আয়াত-২৩) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির বিচার কার্য সম্পাদন করা হবে, তিনি হলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হন, অতঃপর তাকে ডাকা হবে এবং তার নিকট আল্লাহতায়ালার  নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে, সে তা চিনতে পারবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এসব নিয়ামত পেয়ে  কি আমল করেছ? সে বলবে, তোমার রাস্তায় আমি যুদ্ধ করছি এবং শহীদ হয়েছি। আল্লাহতায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি যুদ্ধ করেছ, যাতে মানুষ তোমাকে বাহাদুর বলে। তা তোমাকে বলা হয়েছে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হলে, তাকে তার চেহারার ওপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এক ব্যক্তি ইলম অর্জন করল, মানুষকে শিখাল এবং  কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করল। অতঃপর তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হবে এবং তার ওপর আল্লাহর নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে, সে তা চিনতে পাবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এ বিষয়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি ইলম শিখেছি এবং শিখিয়েছি। তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে  কোরআন পড়েছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, তুমি ইলম শিখেছ, যাতে তোমাকে আলেম বলা হয়। আর  কোরআন তিলাওয়াত করেছ, যাতে তোমাকে এ কথা বলা হয়, লোকটি ক্বারী। আর দুনিয়াতে তোমাকে তা বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হলে, তাকে তার চেহারার ওপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এক ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা সামর্থ্যবান করেছেন এবং তাকে বিভিন্ন ধরনের ধন-সম্পদ দিয়েছেন। তারপর তাকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হবে  এবং তার ওপর আল্লাহর নিয়ামতসমূহ তুলে ধরা হলে, সে তা চিনতে পাবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এ বিষয়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, তোমার জন্য, তুমি যে পথে ব্যয় করাকে পছন্দ কর, সে ধরনের কোনো পথ আমি ছাড়িনি, যেখানে আমি তোমার জন্য ব্যয় করিনি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ, তবে তা করছ, যাতে লোকেরা তোমাকে এ কথা বলে, লোকটি দানবীর। আর দুনিয়াতে তোমাকে তা বলা হয়েছে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের নির্দেশ দেওয়া হলে, তাকে তার চেহারার ওপর, উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহ পাক এধরনের ক্ষতিগ্রস্তদের অশুভ পরিনতি থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন। আর আমাদেরকে একনিষ্ঠতার সাথে একত্ববাদ ও ইখলাসের ওপর আমল করবার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক, শিক্ষার্থী (ইফতা বিভাগ), জামিয়া ইসলামিয়া গাওয়াইর, দক্ষিণখান, ঢাকা

Wordbridge School
Link copied!