• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘মেরাজ’ বিশ্বনবীর অন্যতম মুজিযা


নাঈম কাসেমী সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১, ০৩:৪২ পিএম
‘মেরাজ’ বিশ্বনবীর অন্যতম মুজিযা

ঢাকা : মেরাজ আরবী শব্দ। ঊরুজ থেকে মেরাজ শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ ঊর্ধ্বারোহণ। মূলত নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতপ্রাপ্তির দশম বর্ষে হিজরতের এক বছর পূর্বে রজব মাসের সাতাশ তারিখের রাত্রিতে মক্কা শরিফ থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস হয়ে সাত আসমান পেরিয়ে আরশ-কুরসী তথা আল্লাহর খাস সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর দিদার লাভ করেন। তিনি একই রাতের প্রত্যুষে আবার মক্কায় ফিরে আসেন। এ ঐতিহাসিক ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাকেই মেরাজ বলা হয়। মেরাজের এই ঐতিহাসিক ঘটনা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক অলৌকিক মুজিযাও বটে।

সে রাতে আল্লাহরাব্বুল আলামিন নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রথমে মাসজিদুল হারাম থেকে বুরাকে আরোহণ করিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে যান। সেখান থেকে বিশেষ বাহনে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে ঊর্ধ্ব জগতে তথা সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যান এবং সেখান থেকে ‘রফরফ’ নামক বিশেষ আকৃতির এবং গতিসম্পন্ন বাহন মারফত তাঁকে আল্লাহর চাক্ষুস সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পবিত্র দর্শন লাভ করেন এবং মহান আল্লাহর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথন হয়। সেখানে, আরশ-কুরসী, বেহেশত, দোজখ প্রভৃতি সম্মানিত মেহমানকে দেখানো হয়। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজের পরিভ্রমণ শেষে যখন সাহাবায়ে কিরামের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করেন, তখন হজরত আবু বকর (রা.) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম এক বাক্যে তা বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু বিধর্মী ও নাস্তিকদের নিকট এটি একটি উদ্ভট, কাল্পনিক ও বানোয়াট বলে বিবেচিত হয়েছিল।

বস্তুত এ অত্যাশ্চর্য ঘটনা বস্তুবাদী সভ্যতায় বিশ্বাসীদের মনেও প্রশ্ন জাগিয়েছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজ স্বপ্নে আধ্যাত্মিক, নাকি সশরীরে হয়েছিল? আমরা যদি এ সম্পর্কে পবিত্র  কোরআনে ঘোষিত আল্লাহর শাশ্বত বাণীকে বিচার-বিশ্লেষণ করি, তবে তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে সকলের কাছে। মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র  কোরআনে সকল দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি স্বীয় বান্দা (মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে রাত্রি বেলা মাসজিদুল হারাম (কাবা শরিফ) থেকে মাসজিদুল আকসা (বাইতুল মুকাদ্দাস) পর্যন্ত নিয়ে গেলেন, যার চতুর্পার্শ্বে বরকত দান করেছি। উদ্দেশ্য, তাকে আমার কুদরতের কিছু বিস্ময়কর নিদর্শন দেখাব। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-১) পবিত্র  কোরআনে আরো বলা হয়েছে, ‘তিনি (মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছিলেন। তারপর আল্লাহর নিকটবর্তী হলেন, এমনকি দু-ধনুকের ব্যবধান অথবা তার চেয়ে কাছে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা প্রকাশ করার তা প্রকাশ করলেন।’ (সুরা নাজম, আয়াত : ৬-১০)

উল্লিখিত আয়াত দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজের রাতে পরম করুণাময় আল্লাহর ইচ্ছায় সশরীরে সপ্ত আসমান পরিভ্রমণ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছেছিলেন। সেখানে আল্লাহর তরফ থেকে বিস্ময়কর নিদর্শন দেখানো হয়েছিল এবং কিছু জরুরি নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল। কাজেই এরপর কারো মনে সশরীরে মিরাজ সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ থাকার কথা নয়। খাঁটি মুমিনের জন্য উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ই যথেষ্ট। আজকের মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে যে, চৌদ্দশ বছর পূর্বে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে যে মেরাজ সংঘটিত হয়েছে তা বাস্তব সম্মত। কেননা, আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, জড় জগতে কোনো বস্তুকে আলোর গতিতে ভ্রমণ করানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতা শুধু সৃষ্ট বস্তুর জন্য প্রযোজ্য। মহান স্রষ্টা যিনি সকল শক্তির আধার, তাঁর জন্য তা কখনো বাধা হতে পারে না।

মহাশক্তিধর আল্লাহতাআলা যাকে ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে পারেন। কাজেই আল্লাহর এই সীমাহীন ক্ষমতার প্রতি দৃঢ় আস্থাশীল লোকের নিকট নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সশরীরে ঊর্ধ্বলোক ভ্রমণে কোনো সংশয় থাকতে পারে না। এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহরাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় হাবীবকে ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে গিয়েই শুধু ক্ষান্ত হননি, বরং স্বয়ং এবং তাঁর ফেরেশতা ও পয়গাম্বরগণের দ্বারা সংবর্ধনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে যদি আমরা একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা-ভাবনা করি, তবে তা আমাদের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের বাস্তব জীবনেও কিন্তু এ ধরনের কিছু দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত আমরা যদি কোনো মেহমানকে দাওয়াত দিয়ে বাসায় নিয়ে আসি, তখন আমরা তার জন্য সাধ্যমতো আদর-আপ্যায়ন ও সম্মান করে থাকি। আর মেহমান ও  তোহফাস্বরূপ কিছু না কিছু সঙ্গে নিয়ে আসেন।

নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেরাজের রাতে আল্লাহর সাক্ষাতে গিয়েছিলেন, তখন কিন্তু এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। পিয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আল্লাহর দরবারে গিয়েছিলেন তখন তাঁর উপঢৌকন পেশ করে বলেছিলেন, আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্সালা ওয়াতু ওয়াৎ তায়্যিবাতু- অর্থাৎ ‘আমার মৌখিক, দৈহিক ও আত্মিক ইবাদতসমূহ আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।’ বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবকে  তোহফাস্বরূপ যা দান করলেন তা হলো, আসসালামু আলাইকা আয়্যুহান্ নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু- অর্থাৎ ‘হে নবী! আপনার ওপর আমার (আল্লাহর) শান্তি ও বরকত বর্ষিত হোক।’ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সালাম শান্তিতে অন্য সকলকে শামিল করার জন্য বললেন, আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লা-হিস সালিহীন- অর্থাৎ ‘আমাদের ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক আর তাদের ওপরও শান্তি নাজিল হোক যারা নেক আমল করবে।’ তখন এর সাক্ষীস্বরূপ ফেরেশতাগণের মুখ দিয়ে সাক্ষোক্তি উচ্চারিত হলো, আশহাদু আল্লা-ইলা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু- অর্থাৎ ‘সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসুল।’

উল্লেখ্য, মেরাজের রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় নবীর উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ তোহফাস্বরূপ দান করেছিলেন। নামাজের মধ্যে শেষ বৈঠকে যে তাশাহ্হুদ পাঠ করা হয় সেটি সেই মেরাজের রাতে আল্লাহ ও নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যকার কথোপকথনের স্মৃতি বিশেষ।

এতক্ষণের আলোচনায় আমরা একটি চিরন্তন সত্যের সন্ধান পেলাম। আর তা হল, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে মেরাজ হয়েছিল তা সশরীরেই হয়েছিল এবং ওই দিন আল্লাহরাব্বুল আলামিনের তরফ থেকে তাঁর প্রিয় হাবীবের উম্মতের জন্য তোহফাস্বরূপ যা দেওয়া হয়েছিল তা হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজ নিছক একটি ঊর্ধ্বলোক আরোহণই নয়; বরং এ মেরাজের তাৎপর্য অপরিসীম। অন্তত, মৃত্যু পরবর্তী জীবন, বেহেশত, দোজখ, বরযখ প্রভৃতি যেসব বিষয় সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবের মাধ্যমে আমাদেরকে অবহিত করেছেন, সেই বিষয়গুলোর স্বরূপ কি? এবং সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীবকে মেরাজে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া আল্লাহর আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল, আর তাহলো তার প্রিয় হাবীবকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, আল্লাহ কত মহান, কত বড়, কত ক্ষমতাবান এবং তাঁর সৃষ্টি জগত কত ব্যাপক।

নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের জন্য যে তোহফাস্বরূপ নামাজ মেরাজের রাতে নিয়ে এসেছেন, আমরা কি তা যথাযথভাবে আদায় করি? যে নামাজের বিনিময়ে জীবনে সুখ-শান্তি নেমে আসার কথা, যে নামাজের বদৌলতে সংসার জীবনে অভাব-অনটন দূর হওয়ার কথা, যে নামাজের মাধ্যমে যে কোনো সমস্যার সমাধান হওয়ার কথা, আমরা কি সেই নামাজ সঠিকভাবে কায়েম করছি? যদি তাই পারতাম, তবে কেন আজ ঘরে ঘরে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে? কেন একজন নামাজি নামাজ আদায় করে মিথ্যা কথা বলতে পারে? কিভাবে একজন নামাজি ঘুষ খেতে পারে? অথচ আল্লাহতায়ালা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই নামাজ সকল গর্হিত ও কদর্য কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত-৪৫) সুরা বাকারার ১৫৩ আয়াতে বলা হয়েছে ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের দ্বারা সাহায্য চাও।’

আমরা তো নামাজের মাধ্যমে অনেক কিছুই আল্লাহর কাছে চাচ্ছি, কিন্তু আমরা কি নামাজের হক আদায় করতে পারছি? আসলে আমরা আজ নামাজ তথা ইবাদতের অর্থ-উদ্দেশ্যের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। ইবাদত সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা তা ভ্রান্ত। অজ্ঞতাবশত আমরা আজ শুধু আনুষ্ঠানিক যৎসামান্য ইবাদত ও প্রদর্শনমূলক কিছু অনুষ্ঠানকেই যথেষ্ট মনে করি। আমরা এক ওয়াক্ত নামাজ পড়লে আরেক ওয়াক্ত নষ্ট করি। যা পড়ি তাও তাড়াহুড়ো করে দায়সারাভাবে পড়ি। নামাজ পড়েও অন্যায় ও পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ি। এরূপ নামাজে কিন্তু আমরা ইহকালীন শান্তি এবং পরকালীন মুক্তি ও সাফল্যের আশা করতে পারি না। তেমনিভাবে কেউবা কর্মসূচির মাধ্যমে আবার কেউবা দিবস ভিত্তিক ইবাদত করাকে যথেষ্ট মনে করি। আর এটাকেই আল্লাহর নৈকট্যলাভের উত্তম পন্থা বলে মনে করি। এ ধরনের ইবাদতকারীর মধ্যে প্রায় দেখা যায়, অনুষ্ঠানের সাথে তাদের সম্পর্ক। অনুষ্ঠান শেষ তাদের ইবাদত শেষ। এটা মুসলমানদের জন্য শোভনীয় নয়। মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনটাই তো হবে ইবাদতের পরাকাষ্ঠা।

বস্তুত সর্বপ্রকার ইবাদতের মধ্যে নামাজ সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। আসলে আল্লাহর সার্বক্ষণিক স্মরণের মাধ্যমে তাঁর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে তাঁর প্রতিটি আদেশ-নিষেধ মেনে চলার একটা যোগ্যতা পয়দা করার লক্ষ্যেই আল্লাহতায়ালা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। তাই গুরুত্ব ও যত্নসহ এই নামাজের হক আদায় করা আবশ্যক। আমাদের আজ গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মেরাজের রাতে পরম দয়াময় আল্লাহতায়ালা  তোহফাস্বরূপ যে নামাজ আমাদেরকে দান করেছেন, সেটির আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হূদয়ঙ্গম করে তা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : পরিচালক, জামিয়া শায়েখ আরশাদ মাদানী, চুরখাই, ময়মনসিংহ

 

Wordbridge School
Link copied!