• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলামের দৃষ্টিতে থার্টিফার্স্ট নাইট


মুফতি উবায়দুল হক খান ডিসেম্বর ৩১, ২০২১, ০১:৪৫ পিএম
ইসলামের দৃষ্টিতে থার্টিফার্স্ট নাইট

ঢাকা : বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে বর্ষবরণ, থার্টিফার্স্ট নাইট, এপ্রিল ফুল ও ভ্যালেন্টাইস ডে পালন করা হচ্ছে। বিজাতীদের অনুকরণে মুসলিম তরুণ-তরুণীরাও এতে একাত্ম হয়ে নিজেদের মান-সম্মান ইজ্জত-আব্রু ও ধর্মীয় ঐতিহ্য নষ্ট করছে। ইসলাম কখনো এরকম বিজাতীয় অপসংস্কৃতি সমর্থন করে না। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর রাতটিকে বিশ্বের অনেক দেশে থার্টিফার্স্ব রাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইদানিং আমাদের দেশেও এ রাতটি উক্ত নামে আখ্যায়িত হচ্ছে। যদিও ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপনের রেওয়াজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও আগে থেকে চলে আসছে।

বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। আমাদের দেশে থার্টিফার্স্ব নাইট পালন হচ্ছে-নাচ-গান, বেহায়াপনা এবং চরম অশ্লীলতার মাধ্যমে। দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য হলো, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আধুনিকতার নামে আমাদের তরুণ-তরুণীরা এ রাতে ‘মডার্ন’ হচ্ছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘দুই শ্রেণির জাহান্নামি রয়েছে, যাদের আমি এখনো দেখিনি। এমন সম্প্রদায়, যাদের হাতে গরু পরিচালনা করার লাঠি থাকবে। তা দ্বারা তারা মানুষকে প্রহার করবে। আর নগ্ন পোশাক পরিধানকারী নারী, যারা পুরুষদের নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয়। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ এর সুগন্ধি এত এত দূর থেকে পাওয়া যায়।’ এসব অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে দূরে থাকা ও বর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য।’

মুসলমানের জন্য ইহুদি-খ্রিস্টান ও মুশরিকদের উৎসব উদ্যাপন করা হারাম। নববর্ষ উদ্যাপন করে আমরা তাদের অনুসরণ করতে পারি না। এসব তাদের বানানো উৎসব-কুসংস্কার ও পাপকর্ম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মুশরিকদের সাথে একাত্মতা নয়, বৈপরিত্য রক্ষা করো।’ মহান আল্লাহ যখন মানব সম্প্রদায়কে এভাবে আহ্বান করতে থাকেন তখন আমরা কি করে অশ্লীলতা আর বেহায়াপনায় লিপ্ত থাকতে পারি? এছাড়াও থার্টিফার্স্ট নাইট পালন করা যেসব কারণে হারাম ও নিষিদ্ধ, সেগুলো এখানে আলোচনা করা হলো।

অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা : এ রাত্রিকে কেন্দ্র করে চলে অশালীন ও বেহায়পনার মহোৎসব। যুবতীরা আঁটসাঁট, অশালীন ও নগ্ন পোশাক পরিধান করে অবাধে চলাফেরা করে। অথচ এ প্রসঙ্গে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ওইসব নারী, যারা হবে পোশাক পরিহিতা, কিন্তু নগ্ন। যারা পরপুরুষকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধবিশিষ্ট উটের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।

গান-বাজনা : থার্টিফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে আয়োজিত বিভিন্ন কনসার্টে নারী-পুরুষের একসঙ্গে গান-বাজনা, নগ্ন নৃত্য যেন আবশ্যকীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আল্লাহতায়ালা ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা সম্পূর্ণ হারাম ও অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন।

আতশবাজি ও পটকাবাজি : এ রাতে আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করার জন্য মধ্যরাত থেকে শুরু হয় আতশবাজি আর পটকাবাজি। যা জন মনে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করে এবং জনসাধারণের জন্য কষ্টদায়ক হয়। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।

অর্থ অপচয় : এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক অর্থ অনৈসলামিক ও হারাম কাজে ব্যয় করা হয়। যা অপচয় ও অপব্যয়ের শামিল। আর ইসলাম অপব্যয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

যুবক-যুবতীর অবাধ মেলামেশা : এ রাত্রিতে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, কমিউনিট সেন্টার, সমুদ্রসৈকত, নাইট ক্লাবগুলোতে যুবক-যুবতীরা অবাধে মেলামেলা ও অপকর্মে লিপ্ত হয়। অথচ ইসলাম এগুলোকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘অবশ্যই কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হলে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।’

নেশাদ্রব্য সেবন : এ রাতে উশৃংখল যুবক-যুবতীরা মদ ও নেশাদ্রব্য পান করে মাতাল হয়ে বিভিন্ন অপকর্ম ঘটায়। আর এ কারণেই ইসলাম সমুদয় নেশাদ্রব্যকে হারাম করেছে।

বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্য : থার্টিফার্স্ব নাইট উদ্যাপন সম্পূর্ণরূপে বিধর্মী অপসংস্কৃতি। এ রাত্রিতে HAPPY NEW YEAR বলে অভিবাদন জানানো, আতশবাজি, পটকাবাজি, ফ্যাশন শো, ফায়ার প্লে, ট্যাটো বা উল্কা অংকন, ডিজে ও কনসার্ট, নেশা সেবনসহ বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের অনৈসলামিক ও অপসংস্কৃতিক কার্যাবলি চর্চা করা হয়। আর ইসলাম বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্য রাখাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করলো সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’

চরিত্র ধ্বংসে বিধর্মীদের নীলনকশা : মুসলিম তরুণ-তরুণীদের চরিত্র ধ্বংস করার জন্য ইহুদি-খ্রিস্টানদের নীলনকশার একটি অংশ থার্টিফার্স্ট নাইট। একটি জাতিকে ধ্বংস করার মূল হাতিয়ার হচ্ছে যুবসমাজকে ধ্বংস করা। এ লক্ষ্য নিয়েই তারা সামনে অগ্রসর হচ্ছে। তাই আল্লাহ তাদেরকে অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন।

ক্যালেন্ডার থেকে একটি বছরের বিদায় মানে শুধু সংখ্যার বিদায় নয়, আমাদের জীবনকালের একটি অংশেরও বিদায়। আর এ কারণেই যে কোনো ক্যালেন্ডারের বর্ষশুরু ও বর্ষশেষ উৎসবের ব্যাপার নয়, চিন্তা-ভাবনা ও হিসাব-নিকাশের ব্যাপার। বিনিয়োগ ও লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ। জীবনকাল মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ পুঁজি। আর তার বিনিয়োগক্ষেত্র হচ্ছে তার নিজের কর্ম। জীবনকাল ভালো কাজে ব্যয় হলে তা ফেরৎ আসবে মুনাফাসহ। আর মন্দ কাজে ব্যয় হলে তা বয়ে আনবে পরিতাপ ও ক্ষতিগ্রস্থতা। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কণা পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে। আর যে কণা পরিমাণ মন্দ কাজ করবে সে-ও তা দেখতে পাবে।’

দিন-রাতের গমনাগমন আসলে সতর্ক করছে গত হয়ে যাওয়া জীবনকাল সম্পর্কে। প্রতিটি সন্ধ্যা বার্তা দিচ্ছে, তোমার জীবন থেকে একটি দিবস ফুরিয়ে গেল। প্রতিটি ভোর বার্তা দিচ্ছে, আরো একটি রাত জীবন থেকে বিদায় নিল। কাজেই ব্যয় হয়ে যাওয়া দিবস ও রজনী যদি ভালো কাজে ব্যয় হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহর শোকর, যদি মন্দ কাজে ব্যয় হয়ে থাকে তাহলে ভবিষ্যতের জন্য সংশোধনের সংকল্প- এই হলো মুক্তির ও উন্নতির পন্থা।  কোরআন মাজিদে দিন-রাতের গমনাগমন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে ‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিবসকে পরস্পরের অনুগামীরূপে; তার জন্য যে উপদেশ গ্রহণ করে ও কৃতজ্ঞ হতে চায়।’

রাত-দিনের আসা-যাওয়া একটি ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য ব্যাপার। যা সময়ের চলমানতা সম্পর্কে সতর্ক করে। চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করেন, দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছরের রূপায়ন বস্তুত তার নিজের আয়ুই নিঃশেষ হয়ে চলেছে। কাজেই আর অবহেলা নয়, এবার ব্রতী হতে হবে সৎকর্মে এবং ত্যাগ করতে হবে সকল অপসংস্কৃতির লালন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, বুদ্ধিমান তো সে, যে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কর্ম করে। আর নির্বোধ সে, যে প্রবৃত্তির অনুসারী হয় আর আল্লাহর প্রতি

প্রত্যাশা পোষণ করে।

প্রতিটি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত আমাদের জানাচ্ছে জীবনের ক্ষয় সম্পর্কে। কিন্তু আমাদের সমাজে একশ্রেণির মানুষের জীবনে বর্ষশেষ ক্ষয়ের বার্তা নিয়ে আসে না, আসে অবক্ষয়ের অনুষঙ্গ হয়ে। এ অসঙ্গতি ও অস্বাভাবিকতা এখন সঙ্গত ও স্বাভাবিক। বহুলচর্চা ও ব্যাপক রেওয়াজের কারণে এগুলো অস্বাভাবিক বলেই মনে হয় না। বস্তুত বক্রতার যখন বিস্তার ঘটে তখন বাঁকাকে আর বাঁকা বলে মনে হয় না। তবে মনে না হলেই কি বক্রতা দূর হয়? আমাদের চারপাশে এখন কত বক্রতার ছড়াছড়ি! চিন্তার বক্রতা, কর্মের বক্রতা, রীতি-নীতির বক্রতা! সে সব বক্রতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করলে প্রতিদিনের নামাজে ‘আমাদের পরিচালিত করুণ সরল পথে’ এ প্রার্থনার যথার্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সকল বক্রতা ও অস্বাভাবিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক চিন্তা, যথার্থ কর্ম ও ভারসাম্যপূর্ণ স্বভাবের অধিকারী হওয়া একজন মানুষের প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন। এ যথার্থতা ও ভারসাম্য তথা সিরাতে মুসতাকিমের দিশাই রয়েছে কোরআন মজিদে এবং সুন্নাহ ও সিরাতে। তাই  কোরআন-সুন্নাহর অনুসারী খুব সহজেই মুক্ত থাকে চিন্তা ও কর্মের বক্রতা থেকে। থার্টিফার্স্ট নাইটের অনাচার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এ মহানিয়ামত এবং সচেতন করে আদর্শহীন মানুষের অবলম্বনহীনতা সম্পর্কে। আমরা মহান আল্লাহর শোকর আদায় করি আর থার্টিফার্স্ব নাইড উদ্যাপনকারী মুসলমানদের চিন্তা ও কর্মের স্বাভাবিকতার জন্যও তাঁরই দরবারে প্রার্থনা করি।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো একটি মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে লেখাটি শেষ করছি। তিনি বলেছেন, তোমাদের বিচার করার পূর্বেই নিজেরা নিজেদের বিচার করো। রোজ হাশরে আমলের পরিমাপ করার পূর্বেই নিজেরা নিজেদের আমলের পরিমাপ করো।

কতো অতলস্পর্শী মন্তব্য! নববর্ষে একজন খাঁটি মুমিনের অনুভূতি তো এমন-ই হওয়া বাঞ্ছনীয়। একটি বছর শেষ হওয়ার অর্থ, আমার জীবনপ্রাসাদ থেকে একটি অমূল্য ইট খসে পড়লো। আমার আয়ু এক বছর কমে গেলো। আমি অন্ধকার কবরপানে এক কদম অগ্রগামী হলাম। কত চিন্তার কথা!

নববর্ষ উদ্যাপনের নামে হৈ-হুল্লোড়, আনন্দমিছিল, বেলেল্লাপনা এগুলোর কল্পনা করাও কি সম্ভব? আসুন! অতীতের ভুল-ত্রুটির ওপর অনুতপ্ত হই, ভালো কর্মের ওপর আনন্দিত হই। ভবিষ্যতকে অতীতের চেয়ে আলো-ঝলমলে করার প্রচেষ্টায় প্রবৃত্ত হই। মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে বিজাতীর অনুকরণ, অপসংস্কৃতির লালন থেকে সর্বতোভাবে রক্ষা করুন। নিজেদের স্বতন্ত্র-স্বকীয়তাকে যথাযথ বজায় রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া হামিউস সুন্নাহ, গাজীপুর
সহ-অর্থ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

Wordbridge School
Link copied!