• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ন্যায়পরায়ণ শাসক হজরত ওমর (রা.)


এম এ মান্নান জুলাই ২৯, ২০২২, ১২:২৭ পিএম
ন্যায়পরায়ণ শাসক হজরত ওমর (রা.)

ঢাকা : খোলাফায়ে রাশেদিনের চার খলিফার সবাই ছিলেন ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক। এদিক থেকে হজরত ওমর (রা.)-এর সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল কিংবদন্তির পর্যায়ে। মিসর বিজয়ী সেনাপতি আমর ইবনুল আস তখন মিসরের গভর্নর। তাঁর শাসনে মিসরের জনগণ বেশ শান্তিতেই কাটাচ্ছিল। কিন্তু তাঁর পুত্রের বেয়াড়াপনায় গভর্নরের ন্যায়পরায়ণতার সুনাম নষ্ট হচ্ছিল। সে যখনই পথে বেরোত, নিজের চালচলন দ্বারা সবাইকে বুঝিয়ে দিত সে সাধারণ কেউ নয়, গভর্নরের ছেলে। একদিন সে একজন মিসরীয় খ্রিস্টানের ছেলেকে প্রহার করল। গরিব খ্রিস্টান গভর্নরের কাছে তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পেল না। তাঁর এক প্রতিবেশী মদিনা থেকে ফিরে এসে জানাল, খলিফা ওমর (রা.) অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ শাসক। তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করেন এবং কেউ কারোর ওপর জুলুম করেছে জানলে কঠোর শাস্তি দেন। এ কথা শুনে ওই মিসরীয় খ্রিস্টান মদিনায় খলিফার কাছে গভর্নরের ছেলের বিপক্ষে অভিযোগ করলেন। হজরত ওমর (রা.) তৎক্ষণাৎ আমর ইবনুল আস এবং তাঁর ছেলেকে মদিনায় ডেকে এনে আনীত অভিযোগের বিচারে আদালত বসালেন। সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা আমর ইবনুল আসের (রা.) ছেলে দোষী প্রমাণিত হলো। খলিফা ওমর (রা.) অভিযোগকারীর ছেলেকে বললেন, সে তোমাকে যেভাবে প্রহার করেছে তুমিও সেভাবে ঠিক ততখানি প্রহার কর। তারপর খলিফা বললেন, প্রজারা শাসকের দাস নয়। শাসকরা প্রজাদের সেবক। প্রজারা ঠিক তেমনি স্বাধীন যেমন তাদের মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় স্বাধীন।

হজরত ওমরের (রা.) ন্যায়পরায়ণতা ছিল অতুলনীয়। একবার কিছু সুগন্ধি দ্রব্য বাহরাইন থেকে ওমরের (রা.) নিকট পাঠানো হলো। তিনি সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছ কি, যে এ সুগন্ধি দ্রব্য মেপে সমান ভাগ করে মুসলমানের মধ্যে বণ্টন করতে পার? ওমরের (রা.) স্ত্রী হজরত আতেকা বললেন, আমি পারব। ওমর (রা.) বললেন, আতেকা ছাড়া আর কেউ আছে কি? আতেকা বললেন, আমিরুল মোমিনিন, আমি মেপে দিলে অসুবিধা কী?
ওমর (রা.) বললেন, আমার আশঙ্কা হয়, মাপার সময় তুমি জিনিসটা হাত দিয়ে ধরবে এবং তোমার হাত সুবাসিত হয়ে যাবে। এরপর সেই সুবাসিত হাত তুমি মুখে মেখে নেবে এবং সুগন্ধি উপভোগ করবে। অন্যদের চেয়ে এতটুকু বাড়তি সুবিধা তুমি পেয়ে যাও, তা আমি পছন্দ করি না। ন্যায়পরায়ণতাকে উৎসাহিত করতেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। খলিফা ওমর (রা.) গভীর রাতে ছদ্মবেশে একদিন মদিনার প্রজাদের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। এ সময় দেখতে পেলেন এক রাখাল এক পাল ছাগল নিয়ে যাচ্ছে। তিনি রাখালকে পরীক্ষা করার জন্য বললেন, এ ছাগলগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি ছাগল আমার কাছে বিক্রি করে দাও। রাখাল বলল, এ ছাগলগুলো আমার নয়, আমার মনিবের। ওমর (রা.) বললেন, মনিব তো দেখতে পাবে না। একটা ছাগল বেঁচে দাও। আর মনিবকে বলে দিও যে, একটি ছাগল বাঘে খেয়ে ফেলেছে। রাখাল রেগে চিৎকার করে বলে উঠল, আল্লাহ কি দেখতে পান না? তার কথায় হজরত ওমর (রা.) চুপ করে রইলেন। রাখাল রাগে গরগর করতে করতে ছাগল নিয়ে চলে গেল। পরদিন সকালে ওমর (রা.) ওই রাখালের মনিবের কাছে গেলেন এবং তাকে কিনে নিয়ে স্বাধীন করে দিলেন। বললেন, ওহে যুবক! কাল তুমি আল্লাহ সম্পর্কে যে কথাটি বলেছিলে তা আজ তোমার দুনিয়ার গোলামি চুকিয়ে দিল। আমি আশা করি তোমার এ খোদাভীতি কেয়ামতের দিন দোজখের আজাব থেকেও মুক্তি দেবে।

একবার হজরত ওমর (রা.) এক বেদুইনের কাছ থেকে ঘোড়া কিনলেন। ঘোড়ার দাম পরিশোধ করেই তিনি ঘোড়ায় চড়লেন। কিছু দূর যেতেই ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে খোঁড়া হয়ে গেল। ওমর (রা.) ভাবলেন ঘোড়াটির আগে থেকেই পায়ে কোনো খুঁত ছিল, যা সামান্য ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গেছে। তিনি ঘোড়ার মালিককে বললেন, তোমার ঘোড়া ফেরত নাও। এর পা ভাঙা। সে বলল- আমিরুল মোমিনিন! আমি ফেরত নিতে পারব না। কারণ আমি যখন বিক্রি করেছি, তখন ঘোড়াটি ভালো ছিল। ওমর (রা.) বললেন, ঠিক আছে। একজন সালিশ মানা হোক। সে আমাদের বিরোধ মিটিয়ে দেবে। লোকটি বলল, শুরাইহ বিন হারিস কান্দি নামে একজন ভালো জ্ঞানী লোককে আমি চিনি। তাঁকেই সালিশ মানা হোক। ওমর (রা.) রাজি হলেন। উভয়ে সালিশের জন্য গেলে শুরাইহ খলিফাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমিরুল মোমিনিন! আপনি কি ঘোড়াটি সুস্থ অবস্থায় কিনেছিলেন? ওমর (রা.) বললেন, হ্যাঁ। শুরাইহ বললেন, তাহলে ঘোড়াটি ফেরত দিতে হলে যে অবস্থায় কিনেছিলেন সে অবস্থায় ফেরত দিন। এ কথা শুনে ওমর (রা.) চমৎকৃত হয়ে বললেন, তুমি নির্ভুল ও ন্যায্য রায় দিয়েছ। তুমি কুফা চলে যাও। আজ থেকে তুমি কুফার বিচারপতি। সেই থেকে দীর্ঘ ৬০ বছর তিনি বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। হজরত আলীর (রা.) সময়ে তিনি খলিফার বিরুদ্ধে অনুরূপ আর একটি রায় দিয়ে প্রধান বিচারপতি পদে উন্নীত হন। তারপর উমাইয়া শাসনকালে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের স্বেচ্ছাচারিতায় বিরক্ত হয়ে তিনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কোনো শাসকই তাঁকে পদচ্যুত করার সাহস পাননি।

লেখক : সভাপতি, আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ।

Wordbridge School
Link copied!