• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেনা-সন্দেহে বন্দি কাশ্মীরিদের জীবন


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ১০, ২০১৯, ১১:৫১ এএম
সেনা-সন্দেহে বন্দি কাশ্মীরিদের জীবন

ঢাকা : কাশ্মীর নিয়ে রাজনীতি নতুন নয়। তবে ভারত সরকার এবার যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাতে থমকে গেছে কাশ্মীরিদের জীবন। ঘরের সামনে রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। স্বায়ত্তশাসন হারিয়ে ভারতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্রের আওতায় তাদের জীবনের অধিকার আগের থেকেও বেশি করে আটকে পড়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সন্দেহের কারাগারে। অসুস্থদের অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিতে গিয়ে যেমন মার খেতে হচ্ছে ড্রাইভারকে, তেমনি প্রসব বেদনায় কাতর মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্দেশে বের হয়েও নিরাপত্তা চৌকিতে তল্লাশির মুখে পড়ছেন অসহায় বাবা। এটা স্পষ্টত জুলুম।

গত সোমবার থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারেননি সেখানকার অ্যাম্বুলেন্স চালক গোলাম মোহাম্মদ মীর। তারপরও অসহায় রোগীদের আনা-নেওয়ার কাজ বন্ধ রাখেননি তিনি। গ্রাম ও শহরের অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের পৌঁছে দিচ্ছেন শ্রীনগরের মেজর লাল ডেড ম্যাটারনিটি হসপিটালে। এ কাজ করতে মারধরের শিকারও হয়েছেন তিনি। তারপরও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ভারতীয় সেনা ও তাদের চেক পয়েন্টগুলো ছাড়া সড়কে আর কিছুই নেই। রোগীদের সাহায্য করছি দেখে আমাকে কয়েকবার পেটানো হয়েছে। আমার অপরাধ কী, তা জানি না? আমি আগেও যে কাজ করতাম, এখনো তাই করি। পার্থক্য হলো এখন আমরা কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে। আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার। ডিক্রি জারি করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে সংবিধান, পতাকা ও উত্তরাধিকারগত অধিকার। আমাদের মর্যাদার বিসর্জন হয়েছে। যখন আমি স্বায়ত্তশাসনের অধিকার বাতিলের কথা শুনি, তখন মনে হয়েছে আমি বোধ হয় শরীরের একটি অংশই হারিয়ে ফেললাম। কাশ্মীর আর আগের জায়গায় থাকবে না।

মেয়ের প্রসব বেদনা ওঠার পর তাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকা উত্তরাঞ্চলীয় তানমার্গ এলাকার ৭৩ বছর বয়সি কৃষক গোলাম মোহাম্মদ রেশির জন্য হাসপাতালে যাওয়ার পথটা সহজ ছিল না। কয়েকটি সামরিক চেক পয়েন্টের তল্লাশি পেরিয়ে মেয়েকে নিয়ে তিনি হাসপাতালে পৌঁছান।  ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, এটা জুলুম, অন্যায়, অবিচার।

আমরা যখন পথে নামার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কারফিউ পাস চাইছি, তখন ভারতীয়রা মিষ্টি বিতরণ করে আমাদের সে সম্মিলিত শোক উদযাপন করছে। কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের দিন ওই অঞ্চলে প্রচারিত একমাত্র টিভি চ্যানেল দূরদর্শনে (রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন) সারা দিনই ভারতীয়দের উল্লাসের ফুটেজ প্রচার করা হয়েছে।

কাশ্মীর নিয়ে একই কথা বলছে বিবিসিও। গোটা ভারত এবং পুরো বিশ্ব থেকে যখন কাশ্মীরকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, তখন সেখানকার পরিস্থিতি জানতে বুধবার শ্রীনগরে যান বিবিসির ভারতীয় সংবাদদাতা শুভজ্যোতি ঘোষ। কিন্তু প্রথম ২৪ ঘণ্টায় অনেক চেষ্টা করেও তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেননি সহকর্মীরা। গত বৃহস্পতিবার তিনি কথা বলতে পেরেছিলেন লন্ডনের সহকর্মীদের সঙ্গে। সেই কথোপকথনে কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন।

তিনি জানান, শ্রীনগরে পা রাখার পর ২৪ ঘণ্টারও বেশি পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুপুরীতে এসে পৌঁছেছি। রাস্তা-ঘাটে একশ গজ পরপরই সেনা চৌকি আর কাঁটাতারের ব্যারিকেড। রাস্তায় যত না সাধারণ মানুষ, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে সেনা আর আধা সেনা। মানুষের ছোট ছোট কিছু জটলা দেখতে পেলাম। আমার হাতে বিবিসির মাইক্রোফোন দেখেই তারা এগিয়ে আসে কথা বলতে।

তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ৩৭০ ধারা এবং কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রাতারাতি বিলুপ্ত হওয়ায় তারা কতটা বিক্ষুব্ধ। কেউ কেউ বলেই ফেলেন-মোদি সরকারের দশ মিনিটের জন্য কাশ্মীরে জারি করা কারফিউ তুলে নেওয়ার হিম্মত নেই। কারফিউ তুলে নিলেই তারা দেখবে দলে দলে কত মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সরকার এটা বুঝতে পেরেই গোটা কাশ্মীর উপত্যকা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে দিয়েছে।

ঝিলমের (কাশ্মীরের নদী) তীরে এখন যে স্তব্ধতা, সেটা যে ঝড়ের আগের পরিস্থিতি সেটা স্পষ্ট। শুভজ্যোতি বলেন, বিভিন্ন ঘটনা-বিক্ষোভ-সংঘাতের খবর সংগ্রহ করতে কাশ্মীরে আমি অনেকবারই এসেছি। কিন্তু এ রকম অবস্থা আগে কখনো দেখিনি। এর সঙ্গে যেন আগের কোনো কিছুর তুলনা চলে না। যেন এক মৃত্যুপুরী। রাস্তাঘাটে কোনো লোকজন নেই। রাজ্যজুড়ে প্রায় আড়াই লাখ ভারতীয় সেনা। টানা কারফিউ জারি রয়েছে। দোকানপাট বন্ধ। অনেকের বাড়িতেই খাবার নেই। কেনাকাটার জন্য কেউ কেউ সাহস করে বের হলেও দোকান খোলা না থাকায় তাদের অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে।

চলছে ব্যাপক ধরপাকড়। শ্রীনগরের যেসব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে শহরজুড়ে একটা থমথমে পরিবেশ। চারদিকে আতঙ্ক আর ক্ষোভ। যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। রাজনীতিবিদদের প্রায় সবাই কারাগারে কিংবা গৃহবন্দি। এ পর্যন্ত অন্তত ৬০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গুপকার রোড-যেখানে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বা মেহবুবা মুফতির মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকরা থাকেন, সেখানে কাউকে ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার সকালে আমরা বারবার চেষ্টা করেও যেতে পারিনি।

ডাল লেকের ধারে গভর্নর হাউসের দিকেও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। মনে হচ্ছে গুজবের শহর হয়ে উঠেছে শ্রীনগর। শোনা যাচ্ছে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে কিছু কিছু জায়গায় মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে। কিন্তু শ্রীনগরের কোথাও আমরা কোনো বিক্ষোভ দেখিনি। এক ট্যাক্সিচালক বলেন, বেরামিতে যান। ওখানে দশ হাজার বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোকজন পথে নেমে বিক্ষোভ করছে। আদৌ এ রকম কিছু ঘটছে কি না, তা যাচাই করার কোনো উপায় নেই। কারণ কাশ্মীরে এখন কার্যত একটা অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। রোববারের পর এখানকার কোনো নিউজপোর্টাল আর আপডেট হয়নি; কারণ ইন্টারনেট বন্ধ। কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হতে পারছে না। দিল্লি বা জম্মু থেকে কিছু সংবাদপত্র এখানে এলেও সেগুলোতে নাকি সেন্সরের কাঁচি পড়ছে।

তারপরও মানুষ এগুলো পড়ছে, কারণ তাদের জানার আর কোনো মাধ্যম নেই। যেতে পারে কাশ্মীরে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠ একরকম রোধ করেই রাখা হয়েছে। দু-তিন দিন পরেই মুসলিমদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব, ঈদুল আজহা। কিছু ব্যবসায়ী ভেড়ার পাল নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কেনার মতো কেউ নেই। এ রকম একটা পরিবেশে কে কোরবানি দেবেন, কার কাছে মাংস বিতরণ করবেন। কাশ্মীরের মানুষের ঈদের আনন্দ এবার মাটি, এক নিরানন্দ ঈদের অপেক্ষায় তারা।

গত সোমবার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে ভারত সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়। এ নিয়ে শুরু থেকেই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান। কাশ্মীর ইস্যুকে সম্ভাব্য সবকিছু করার ঘোষণা দেয় দেশটি। ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শিথিল থেকে শুরু করে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থগিত করেছে পাকিস্তান। এছাড়া কাশ্মীর ইস্যুতে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন বিশ্বনেতারাও। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কাশ্মীর নিয়ে আবারো উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারত ও পাকিস্তানকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে বলেছেন। জম্মু-কাশ্মীরের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে পারে, এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে এই ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের নাক গলানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সিমলা চুক্তি সমুন্নত রাখতে বলেছেন। ওই চুক্তিতে জম্মু ও কাশ্মীরের চূড়ান্ত অবস্থা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের কথা বলা আছে।

কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানকে শান্তি বজায় রাখতে ও সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে কাশ্মীরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মরগ্যান ওরটেগাস। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হচ্ছে, কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় ইস্যু। শান্তি রক্ষা এবং আলোচনার সুযোগ তৈরিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে দুই দেশের ওপর। তবে যুক্তরাষ্ট্র চায় কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশ আলোচনায় বসুক।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!