• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার ও মাতৃমৃত্যু বেড়েছে


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ১১, ২০২০, ০২:১০ পিএম
বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার ও মাতৃমৃত্যু বেড়েছে

ঢাকা : করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে স্বাস্থ্য খাতের ওপর চাপ বেড়েছে। স্বাভাবিক রোগাক্রান্তদেরও নানা দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে এ সময়। করোনাকালীন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কারণে দেশে বেড়েছে বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার। এর সঙ্গে বেড়েছে মাতৃমৃত্যুর হারও। স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাতৃমৃত্যুর প্রধান দুটি কারণ একলামসিয়া বা খিঁচুনি ও প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ। হোম ডেলিভারিতে এ দুটো সমস্যা বেশি দেখা দেয়।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, হাসপাতালগুলোতে সীমিত সার্ভিস, যানবাহন সমস্যা, সময়মতো সেবা না পাওয়ার আশঙ্কা এবং ছুটির দিনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, গুণগত বা নির্ধারিত সেবা না পাওয়া মাতৃমৃত্যু বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

অবস্ট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি বাংলাদেশ (ওজিএসবি) বলছে, করোনা মহামারীর আগে বাড়িতে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৩২ শতাংশের মতো। কিন্তু করোনার সময়ে ওজিএসবি’র ১৪টি শাখার তথ্য বলছে,  শতকরা ৫৪ শতাংশ বাড়িতে মাতৃমৃত্যু বেড়েছে।

গণমাধ্যম ও দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে নেওয়া তথ্য বলছে, লকডাউনের সময়ে পরিবার পরিকল্পনা সার্ভিস ছিল বেশ নড়বড়ে। লকডাউন থাকার কারণে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে ‘ম্যাটেরিয়াল’ পৌঁছাতে পারেননি। সেই সার্ভিস ছিল না। পরিবার পরিকল্পনা সেন্টারগুলোও বন্ধ ছিল। যে কারণে তারা উপকরণও পাননি। ফলে এ সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বেড়ে যায়।

ওজিএসবি বলছে, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কারণে সন্তান প্রসবের হার বেড়েছে। একই সঙ্গে গলির দোকান থেকে গর্ভপাতের ওষুধ খাবার কারণে রক্তক্ষরণ হয়ে অনেক মা মারা গেছেন। আবার শুধু সন্তান প্রসবের সময় মা মারা গেছেন তা-ই নয়, ‘আর্লি

প্রেগনেন্সিতে’ ও নানা জটিলতার কারণে মায়েদের মৃত্যু বেড়েছে। ইউনিসেফ বলছে, দেশে গত এপ্রিল থেকে ৪০ সপ্তাহ বা ১০ মাসে ২৪ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করবে। এই ৪০ সপ্তাহ শেষ হবে আগামী বছরের জানুয়ারিতে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এবং জুলাইয়ের প্রথম দিকে জরিপ করা ১০৩টি দেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই পরিবার পরিকল্পনা এবং গর্ভনিরোধক পরিষেবাগুলোতে ব্যাঘাত ঘটেছে।

গত আগস্ট মাসে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট জানায়, ‘করোনার কারণে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোতে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার বাড়তে পারে, পরিবার পরিকল্পনা সেবা ৯ দশমিক ৮ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমবে, আর বাড়বে অনিরাপদ গর্ভপাত। একই সঙ্গে প্রসব পূর্ব ও প্রসব পরবর্তী সেবা কমে যেতে পারে ১৫ শতাংশ করে।’

ল্যানসেটের এ আশঙ্কা সত্যি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বলছে, অন্য সবকিছুর সঙ্গে মাতৃস্বাস্থ্যসেবাও বিঘ্নিত হয়েছে। তারা বলছেন, এই মুহূর্তে এ সংক্রান্ত সার্ভে করা যাচ্ছে না। আমরা বুঝতে পারছি, মাতৃমৃত্যু বাড়ছে। কিন্তু কত শতাংশ বাড়ছে, সেটা বলা যাচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, জুন-জুলাই মাসে মায়েদের হাসপাতালে আসা কমে। তবে এখন তা আবার বাড়ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, যাদের আগে থেকেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হয়েছে, নানা জটিলতার কারণে তাদের প্রতি  নির্দেশনা থাকে, পরবর্তী সন্তানের জন্ম যেন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হয়। কিন্তু তারা যখন হাসপাতালে আসেন না, তখন নানা জটিলতার কারণে জরায়ু ফেটে যায়। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা সদর হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যাও। একইসঙ্গে কোভিডের কারণেও অনেক মায়ের মৃত্যু হয়েছে এ সময়ে।

আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শারমিন আব্বাসী বলেন, ‘করোনার সময়ে আনএক্সপেক্টেড প্রেগনেন্সির টার্মিনেট নিজেরাই করতে চেয়েছেন। সেখানে অনেক মা রক্তক্ষরণে মারা গেছেন। আর জানুয়ারির পর পুরোটা বোঝা যাবে এই মায়েদের অবস্থা কী ছিল।’ ‘এটা একটা ক্রাইসিস’ মন্তব্য করে ডা. শারমিন আব্বাসী বলেন, ‘প্রথম দিকে হাসপাতালগুলোতে মায়েরা ভর্তি হতে পারেননি। সবকিছু মিলিয়ে উইমেন হেলথ ডেথ বেড়েছে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, ‘যেসব মা নিয়মিত চেকআপে থাকতেন, তারা করোনার সময়ে থাকতে পারেননি। এ কারণে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ মা, যাদের অবশ্যই হাসপাতালে ডেলিভারি করাতে হবে বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধায়নে, কিন্তু অনেকে সে সুযোগ পাননি। কারণ তাদের শনাক্ত করা যায়নি।’

‘দেশে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ। কিন্তু করোনার এ সময়ে চিকিৎসা অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে। সীমিত হয়েছে ডোনার ঠিক সময়ে না পাওয়া, ব্লাড ব্যাংকগুলোতে রক্ত স্বল্পতার কারণে’, বলেন ডা. রেজাউল করিম কাজল।

‘মায়েদের সেবার আওতায় আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে। বিভিন্ন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে’, মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মা, শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্য কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক।

তিনি বলেন, ‘মাতৃমৃত্যুর প্রধান দুই কারণ, একলামসিয়া আর প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ। আর তাই এই দুই সমস্যার জন্য ওষুধসহ যা যা প্রয়োজন সেগুলো হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে। ওষুধ রাখার জন্য প্রতিটি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে একটি ফ্রিজ এবং ব্যবহারের প্রটোকলও দেওয়া হয়েছে।’

মাতৃমৃত্যু হার কমিয়ে আনতে সরকার প্রতিটি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে মোবাইল সেবা চালু করেছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মোবাইল নম্বর নির্ধারণ করেছে, মায়েরা সেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সরাসরি লেবার রুমের সঙ্গে কানেক্ট হতে পারবেন। জেলা হাসপাতালেও এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে করে মায়েরা অন্তত একটা জায়গা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন, বলেন ডা. শামসুল হক।

আর বাড়িতে যদি সন্তান প্রসব করতেই হয়, তার জন্য যারা প্রসব করাচ্ছেন, তাদের প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য যে ওষুধ সেটাও দেওয়া হচ্ছে। যেসব মায়ের সন্তান প্রসব হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের এর আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে ডা. শামসুল হক বলেন, ‘এটা অবশ্যই বড় একটা চ্যালেঞ্জ।’

পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল জানান, ২০১৯ সালের মার্চ মাসে প্রসবপূর্ব সেবা নিয়েছেন ৪২ হাজার ৫৩৬ জন নারী, চলতি বছরের মার্চে সেটা ছিল ২৫ হাজার ৪১৫ জন। আর গত বছর এপ্রিলে এই সেবা নিয়েছিলেন ৪২ হাজার ৫৭১ জন নারী, চলতি বছরের এপ্রিলে নিয়েছেন ১৮ হাজার ৬২ জন।

২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালের এই কয় মাসে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে জানিয়ে ওজিএসবি’র সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘হাসপাতালগুলোতে যে মৃত্যু দশমিক ৬ শতাংশ ছিল, সেটা এখন হয়েছে দশমিক ৯ শতাংশ। এই হিসাবে গত বছর যে মৃত্যু ছিল তার কয়েকগুণ বেড়ে যাবে কেবল হাসপাতালগুলোতেই।’
তিনি বলেন, ‘সময়মতো হাসপাতালে না আসার কারণে শেষ মুহূর্তে তারা আসেন। কিন্তু তখন আর  কিছুই করার থাকে না।’ ‘আবার পুরোপুরি যে সেবা একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে দেওয়া দরকার, সেটা এখন দেওয়া হচ্ছে না। এটা একটা কম্প্রোমাইজড অবস্থায় রয়েছে’, বলেন অধ্যাপক সামিনা চৌধুরী।

অবস্থা জটিল না হলে অনেকেই বাড়িতে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা করেছে বলে জানান সেভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে জড়িত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ইশতিয়াক মান্নান। তিনি বলেন, করোনার কারণে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে সেবা ব্যাহত হয়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফৌজিয়া জাহান বলেন, করোনার সময়ে মায়েরা চাইলেও হাসপাতালে ওইভাবে আসতে পারেননি। এ ছাড়া হাসপাতালে এলে করোনা আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কাও তাদের মনে কাজ করেছে। সব মিলিয়ে বাড়িতেই সবাই বাচ্চা প্রসব করতে চেয়েছেন। এতে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। চিরায়ত গ্রামীণ ‘দাই’ পদ্ধতিও অনেকে গ্রহণ করেছেন। এতে করে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে মা-শিশুমৃত্যু বেড়েছে বলে মনে করি।

মাতৃমৃত্যু রোধে কাজ করছে সরকার জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। করোনাকালে মানুষকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!