• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিমানে ফের চোরাচালান


বিশেষ প্রতিবেদক নভেম্বর ২০, ২০২০, ১১:০৯ পিএম
বিমানে ফের চোরাচালান

ঢাকা : বিমানের ভেতরে স্পর্শকাতর স্থান ব্যবহার করে আবারো স্বর্ণ চোরাচালান হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের চোরাচালানবিরোধী নানামুখী পদক্ষেপে কিছুটা কমে এলেও আবারো এ প্রবণতা বেড়েছে।

এ বিষয়ে ইতোমধ্যে গোয়েন্দারা একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদনে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গত ৬ নভেম্বর টয়লেটের ভেতরে সুরক্ষিত করে রাখা থেকে প্রায় সাড়ে ৮ কেজি ওজনের ৬৮টি স্বর্ণবার জব্দ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বর্ণের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সোনা চোরাচালানও। এতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বর্তমানে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ৭৩ হাজার ৭১৬ টাকা।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সূত্রে জানা গেছে, প্রতিনিয়ত প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান চালিয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। মাঝেমধ্যে বড় অভিযানে এই কারবারিদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকরে আবার বেরিয়ে আসছে।

উড়োজাহাজের স্পর্শকাতর স্থান দিয়ে পাচার হয় স্বর্ণের বড় চালান : উড়োজাহাজের ভেতরে স্পর্শকাতর স্থান ব্যবহার করে আবারো চোরাকারবারি সিন্ডিকেটগুলো বড় বড় স্বর্ণের চালান পাচার করার পরিকল্পনা করছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের এমন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উড়োজাহাজের অভ্যন্তরে স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

পূর্বে উড়োজাহাজের অভ্যন্তরে বিশেষ কায়দায় কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বড় বড় স্বর্ণের চালান নিয়ে এসেছে চোরাকাবারি চক্র। শুল্ক, শুল্ক গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় এগুলো উদ্ঘাটিত হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছেন উড়োজাহাজের পাইলট, কেবিন ক্রু থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি এই প্রবণতা কমে গেলেও আবারো একটি চক্র উড়োজাহাজ ব্যবহার করে স্বর্ণের চালান নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দু-একটি চালান ধরাও পড়েছে। তবে এর বাইরে চালান বাইরে চলে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা লিখিত আকারে পুনরায় উড়োজাহাজের স্পর্শকাতর স্থানের ভেতর করে চোরাচালান সিন্ডিকেট চক্র স্বর্ণ পাচার করতে পারে এমন আশঙ্কা করে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।

সূত্র জানায়, উড়োজাহাজের সেই সমস্ত লুকায়িত জায়গা যা সচরাচর কখনো তল্লাশির আওতায় আসবে না বলে ধারণা করা হয়, সেই সমস্ত স্পর্শকাতর জায়গাকে স্বর্ণ চালান রাখার স্থান হিসেবে নির্বাচিত করে স্বর্ণ চোরাকারবারিরা। উড়োজাহাজের এক শ্রেণির কর্মকর্তা, পাইলট, কেবিন ক্রু এমনকি লোডারদের ম্যানেজ করে বড় বড় স্বর্ণের চালান নিয়ে আসে তারা। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক ধরা পড়লেও বেশিরভাগই চালান বাইরে চলে গেছে বলে ধারণা করা হয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানা যায়, উড়োজাহাজের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা মনে করা হয় কার্গো হোলের অন্তর্মুখী পার্শ্বের প্যানেল বক্স। এখানে ১২টি পর্যন্ত প্যানেল বক্স থাকে। এগুলোর কাভার প্লেট স্ক্রু দিয়ে থাকে। এর অভ্যন্তরে উড়োজাহাজের যাবতীয় ইউটিলিটি পাইপ এবং অন্যান্য সংবেদনশীল কানেক্টিভিটি আউটলেট থাকে যাতে টেকনিশিয়ান ছাড়া অন্যদের যাওয়ার কথা না। ডিসি-১০ মডেলের মতো এই জাতীয় উড়োজাহাজের এই স্থানটি খুবই নিরাপদ জায়গা বলে মনে করা হয়।

এছাড়া নিরাপদ জায়গা মনে করা হয় উড়োজাহাজের ওয়াশরুমকেও। এর পাশাপাশি ইংলিশ কমোড-এর পার্শ্ববর্তী স্থান, লুকিং গ্লাসের পেছনের স্থান, গ্যাস মাস্ক সকেট এবং যাত্রী আসনের নিচে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্যানেল বক্স থেকে মালামাল নামানোর সময় একাধিক সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি করতে হবে। পাশাপাশি উড়োজাহাজ হ্যাঙ্গারে নিয়ে আসার সময় একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, পূর্বে দেশের ইতিহাসে ১২৪ কেজি স্বর্ণের চালান নিয়ে আসা হয়েছিল প্যানেল বক্সের ভেতর করে। পরে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ও কাস্টমস যৌথ অভিযান চালিয়ে স্বর্ণের চালানটি উদ্ধার করে। এছাড়া সিটের পেছনে, গ্যাস মাস্ক সকেট, কমোডের ভেতরে বিশেষ কায়দায় রাখা অবস্থায়ও স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনা রয়েছে।

এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন শিমুল বলেন, এখন থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে আবারো বড় বড় চালান নিয়ে আসবে চোরাচালান চক্র। তিনি বলেন, বিপুল অর্থের লোভ দেখিয়ে এক শ্রেণির কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে চোরাকারবারিরা নিরাপদে এই প্রক্রিয়ায় স্বর্ণ পাচার করে থাকে।

তিনি বলেন, আবার ওই চক্রটি এই পাঁয়তারা করছে। তবে আমরা সতর্ক রয়েছি এবং উড়োজাহাজের ওই সব স্থানে বিশেষ নজরদারির আওতায় আনার জন্য আমরা বলেছি।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, এসব অপরাধী শুধু স্বর্ণ চোরাচালানি নয়, যুক্ত হয় আরো নতুন নতুন চোরাকারবারে। স্বর্ণের দামের তারতম্যের সঙ্গে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরাট ভূমিকা রয়েছে বলেও মনে করা হয়। বড় চালান ছাড়াও ছোট ছোট চালান প্যান্টের ভেতর, কম্বলের ভেতর, পেটের ভেতর, যাত্রীর জুতোর ভেতর, এমনকি মানিব্যাগেও ৪/৫টি করে স্বর্ণের বার চোরাচালান হয়ে আসছে হরহামেশা।

দেখা যায়, এ দেশের অন্যতম একটি বড় পাচারকারী সিন্ডিকেট বেশ ক’বছর আগে সাভারের ভাগুঢ্যা এলাকা থেকে র্যাব-১ এর হাতে ধরা পড়ে। মাইক্রোবাসে করে ৭ কেজি ৯৯১ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বার নিয়ে চার চোরাকারবারি অবৈধ পন্থায় বেনাপোল সীমান্তে পাচারের লক্ষ্যে রওনা হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল তাপস মালাকার, তার স্ত্রী মন্টি মালাকার, দুলাল চন্দ্র দাস ও অন্য একজন। মামলা হয় সাভার থানায়।

জানা গেছে, সাজাও হয়েছে এদের। এর আগে পলি রানী দাস নামে এক চোরাকারবারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের ৪ কেজি ৪৬০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের বারসহ বিমানবন্দর কাস্টমসের হাতে ধরা পড়ে।

আটক হওয়ার পর কাস্টম অ্যাক্ট ও স্বর্ণ চোরাচালান আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে উক্ত বন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আবু সাঈদ বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। সাজা হওয়ার ঘটনা স্বস্তিদায়ক। তবে শাস্তি আরো কঠোর করলে এ ধরনের অপরাধ ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে মনে করে বিজ্ঞমহল।

কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, যত সোনা ধরা পড়ছে, তার কয়েকগুণ বেশি সোনা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাচার কমবেশি হলেও তা পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না।

সোনা চোরাচালানের মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চোরাচালানে জড়িত ২৬টি চক্রকে পুলিশ শনাক্ত করেছে। এসব চক্রে রয়েছে একাধিক নেতা, মানি এক্সচেঞ্জ ও হুন্ডি ব্যবসায়ী।

তথ্য মতে, চোরাই স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিমানবন্দর কাস্টমসের অসাধু কর্মচারী ও কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে দুবাই ও ভারতের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জড়িত বলে জানা যায়। আর এসব চালান সাধারণত দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে আসে। বাংলাদেশি চক্রের সদস্যরা মূলত চোরাই সোনা প্রাপকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেন। আবার অনেকে আছেন বেশি মুনাফার লোভে বিনিয়োগও করেন এসব কাজে।

জানা গেছে, ভারতের বাজারে সোনার দাম বেশি থাকায় বাংলাদেশকে সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিরা। তাদের সঙ্গে আছেন বেশকিছু অসাধু সোনা ব্যবসায়ীও।

সূত্র জানায়, শুধু ভারতে পাচারই নয়, রাজধানী ঢাকাসহ বেশ কিছু এলাকার স্বর্ণ ব্যবসায়ী চোরাকারবারিদের কাছ থেকে স্বর্ণের বার সংগ্রহ করে থাকে। অন্যদিকে এসব চক্র দেশের অভ্যন্তরে স্বর্ণ পাচারের পর সড়কপথে প্রতিবেশী দেশে উচ্চমূল্যে স্বর্ণ পাচার করার সময় প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!