• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
ভাগ্যবন্দি ৪৭ হাজার গ্রামপুলিশের

কবে শেষ হচ্ছে বঞ্চনা


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ২৮, ২০২০, ১১:৪৭ পিএম
কবে শেষ হচ্ছে বঞ্চনা

ঢাকা : আদালতের আদেশ আসায় দেশের  ৪৭ হাজার গ্রামপুলিশের বঞ্চনা আর কষ্টের প্রহর শেষ হচ্ছে না। উচ্চ আদালতের রায় গ্রাম পুলিশের পক্ষে যায়। এরপর সেই রায়ে সরকার আপিল করে। আপিল বিভাগের রায়ে ৮ সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে সরকারকে লিভ টু আপিলের নির্দেশ দেয়। আর সেই লিভ টু আপিলের নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয় আগামী বছরের ২৬ জুলাই। বর্তমানে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে একজন করে দফাদার ও ৯ জন করে মহল্লাদার রয়েছে। দফাদারেরা ৭ হাজার ও মহল্লাদাররা সাড়ে ৬ হাজার ৫০০ টাকা বেতনভাতা পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া প্রতি মাসে ১২০০ টাকা যাতায়াত ভাতা পেয়ে থাকেন।

সূত্রে জানা যায়,  আদালতের দীর্ঘদিন ধরে তারা সরকারের কাছে জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন-ভাতার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সরকার একাধিক সময়ে তাদের আশ্বাস দিলেও সেসব আশ্বাস আলোর মুখ দেখেনি। অবশেষে ২০১৭ সালে সরকারি স্কেলে বেতন-ভাতা পেতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন তারা। ২০১৯ সালে উচ্চ আদালতের রায়ও তাদের পক্ষে আসে। তবে সে রায় বাস্তবায়ন না করে সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করায় তাদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৮ সালের ৯ জুলাই তৎকালীন সরকার গ্রাম পুলিশের একটি অংশের সঙ্গে সমঝোতা করে তাদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা দিতে রাজি হয়। ওই বছরই গ্রামপুলিশ তাদের বেতন-ভাতার জন্য প্রস্তাব পাঠায় মন্ত্রণালয়ে। তিন-চারবার এই প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা নাকচ করে অর্থ মন্ত্রণালয়।

রে ২০১২ সালে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, দফাদার ও মহল্লাদারদের চাকরি পাকিস্তান আমল থেকে একই নিয়মে চলে আসছে। নতুন করে তাদের চতুর্থ শ্রেণির চাকরির মর্যাদা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

এরপর ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার ধামরাই উপজেলার দফাদার মোঃ লাল মিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ৩৫৫ জন গ্রামপুলিশ সদস্য হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন।

একই বছরের ৩ ডিসেম্বর ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট একটি বেঞ্চ রুল জারি করেন। এতে ২০০৮ সালের সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামপুলিশ সদস্যদের চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল যথাযথ ঘোষণা করে তাদেরকে জাতীয় বেতন স্কেলের ১৯তম এবং ২০তম গ্রেডে বেতন প্রদানের রায় প্রদান করেন। চলতি বছরের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

চূড়ান্ত রায়ে ২০১১ সালের জুন মাস থেকে দফাদারদের ১৯তম এবং মহল্লাদারদের ২০তম বেতন গ্রেড প্রদানের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই রায়ে তাদেরকে চাকরিতে যোগদানের তারিখ থেকে সময়কাল গণনা করে অবসরভাতা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। রাষ্ট্রপক্ষের আপিল গ্রহণ করে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। একইসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল দায়ের করার জন্য নির্দেশ দেন।

পরে চলতি বছরের জুন মাসে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রপক্ষ ১৫ অক্টোবর লিভ টু আপিল দায়ের করে। পরে চেম্বার জজ আদালত মামলাটি ২০২১ সালের ২৬ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন।

আদালতে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী হ‌ুমায়ূন কবির পল্লব। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান।

রায়ের বিষয়টি উল্লেখ করে আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লব  বলেন, ‘২০১৭ সালে লাল মিয়াসহ ৩৫৫ জন গ্রামপুলিশ সদস্য সরকারি স্কেলে বেতন-ভাতা দাবি করে রিট দায়ের করেন। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত দফাদারকে ১৯তম গ্রেডে এবং মহল্লাদারকে ২০তম গ্রেডে বেতন প্রদানের রায় দেন।

তিনি আরও বলেন, ‘এ রায় বাস্তবায়ন হলে আবেদনকারী ৩৫৫ জন হলেও দেশের প্রায় ৪৭ হাজার গ্রামপুলিশ সদস্য এর সুবিধা ভোগ করবেন। রায়ে ২০১১ সালের ২ জুন থেকে গ্রামপুলিশ সদস্যদের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করা এবং অবসরভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ যোগদানের তারিখ হতে সময়কাল গণনা শুরু করতে বলা হয়েছে।’

রায় আট সপ্তাহের স্থগিতের বিষয়টি উল্লেখ করে আইনজীবী হুমায়ূন কবির জানান, পরে গত বছর ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। রাষ্ট্রপক্ষের আপিল গ্রহণ করে একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। একইসঙ্গে লিভ টু আপিল দায়ের করার জন্য নির্দেশনা দেন।

চলতি বছরের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরে রাষ্ট্রপক্ষ ১৫ অক্টোবর লিভ টু আপিল দায়ের করলে আদালত মামলাটি ২০২১ সালের ২৬ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন বলে জানান রিটকারীদের আইনজীবী।

রায়ের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘এমনিতেই গ্রামপুলিশ সদস্যদের সবাই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বর্তমান বাজারে মাত্র ৬-৭ হাজার টাকায় একটি সংসার পরিচালনা করা অত্যন্ত কষ্টকর এবং দুরূহ। তারপরও তারা কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ৭০ ধরনেরও বেশি কাজ করে থাকেন। তাদের কাজের জন্য কোনো নির্ধারিত সময়সীমা নেই। ২৪ ঘণ্টায় তাদেরকে কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। মানবিক কারণে হলেও সরকার এসব অসহায়, দরিদ্র ও বঞ্চিত গ্রামপুলিশদের সহায়তা করা উচিত।’

গ্রামপুলিশ বাহিনী রিট বাস্তবায়নকারী কমিটির সভাপতি দফাদার মোঃ উজ্জ্বল খান বলেন, ‘আমরা যারা গ্রামপুলিশের চাকরি করি তারা সবাই দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়ে। সরকার আমাদের যে টাকা দেয় তা দিয়ে বর্তমান বাজারে কোনোভাবেই একটি সংসার চালানো সম্ভব না। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমাদের সরকারি স্কেলে বেতন-ভাতা দিয়ে পরিবার নিয়ে খেয়েপড়ে বাঁচার সুযোগ দিন।’

যেভাবে গ্রামপুলিশের যাত্রা শুরু হয় : প্রাচীন বাংলায় জাগানিয়া (সতর্ককারী), প্রহরী, অষ্টপ্রহরী, (২৪ ঘণ্টা পাহারারত) ইত্যাদি নামে গ্রামপুলিশের অস্তিত্ব ছিল।

মোগল আমলে গ্রামপুলিশ পাশবন, নিঘাবন ও চৌকিদার নামে পরিচিত ছিল। তারা গ্রামবাসীদের সেবক হিসেবে কাজ করতেন। গ্রামবাসীরা তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেন। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারতবর্ষের অধিকাংশ গ্রামে পঞ্চায়েত প্রথা চালু ছিল।

তাদের কাজ ছিল বিচারকার্য সম্পাদন ও গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা ব্রিটিশ আমলে জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি করা হয় এবং রাজস্ব আদায় ও স্থানীয় শান্তি-শৃঙ্খলা দায়িত্ব তাদের উপরই (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন ১৭৯৩) এতে কাজের পরিধি বেড়ে যায়। ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে পঞ্চায়েত গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পৃথক লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।

এরই ধারাবাহিকতায় গ্রাম চৌকিদারি আইন-১৮৭০ জারি করা হয়। এ আইনের অধীনে ইউনিয়ন পর্যায়ে চৌকিদার পঞ্চায়েত গঠন করা হয়। এ পঞ্চায়েত গ্রামে চৌকিদার নিয়োগ করে পাহারার ব্যবস্থা নিতেন। এভাবেই মূলত গ্রামপুলিশের যাত্রা শুরু হয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!