• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
মহাপরিকল্পনায় সাজবে ঢাকা

আবার খালে চলবে নৌযান


বিশেষ প্রতিবেদক জানুয়ারি ১৬, ২০২১, ০৫:০৫ পিএম
আবার খালে চলবে নৌযান

বালু নদী সংযুক্ত রাজধানীর রামপুরা খাল খনন ও উন্নয়ন কাজ চলছে

ঢাকা : রাজধানীর খালগুলো উদ্ধার ও খনন করে হাতিরঝিলের আদলে হবে যোগাযোগব্যবস্থা। মহাপরিকল্পনার আওতায় খালগুলোতে পানি নিষ্কাশন সচল রাখার পাশাপাশি তৈরি হবে নৌপথ। 

নগরীর ২৬টি খালের সংযোগ হবে রাজধানী ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে। দুপাড়ে পথচারী হাঁটার জন্য রাস্তা তৈরিসহ বেশ কয়েকটি খালের পাশে তৈরি হবে ভারী যানবহান চলাচলের সড়ক। এসব খাল দৃষ্টিনন্দন করতে এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। 

ঢাকার প্রাণ-সঞ্চারকারী নদী বুড়িগঙ্গার সাথে এক সময় সরাসরি নৌপথের সংযোগ ছিল রাজধানীর বিভিন্ন খালের। বিভিন্ন জলযান চলতো এসব খাল দিয়ে। কিন্তু সে দৃশ্য এখন কল্পনা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহল খালগুলো আস্তে আস্তে দখল করে নিয়েছে। কাগজ-কলমে খালগুলো থাকলেও বাস্তবে নেই। যে কারণে রাজধানীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে। পানি নিষ্কাশনের দুটি পথ। 

প্রথমত, ভূগর্ভে পানি শোষণ করে নেওয়া এবং অন্যটি খালবিল বা ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া। রাজধানী ঢাকায় এই দুটি পথের একটিও কার্যকর নেই। যে কারণে অল্প কিছুক্ষণের বৃষ্টিতেই রাজধানীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

নগরবিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর বাস্তবতা হচ্ছে মানুষের হাঁটার চেয়েও যানবাহনের গড় গতি কম। এ অবস্থায় যানজট ঢাকা নগরীকে কার্যত এক অচল এবং স্থবির নগরীতে পরিণত করেছে। এটি একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখা দেওয়ায় পরিবহন খাতে বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো ছাড়া কোনো উপায় নেই। যানজট সমস্যার সমাধান না হওয়ায় প্রতিদিনই অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে উন্নয়ন। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অগ্রগতি। 

শুধু তাই নয়, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণে নানা সংক্রামক ব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। যানজটে নগরবাসীর প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাও মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে দিন দিন। 

এ অবস্থায় রাজধানীর হারিয়ে যাওয়া নৌপথ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগকে অনেকটা বিজ্ঞানসম্মত বলে মনে করছেন তারা। 

নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এটি খুবই আশার খবর যে, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে ঢাকার খালগুলো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের পুরো দায়িত্ব পেল দুই সিটি করপোরেশন। আগে এ দায়িত্বের বেশিরভাগ পালন করতো ঢাকা ওয়াসা। 

ফলে কোন সংস্থা কী দেখভাল করবে এ নিয়ে দ্বন্দ্বের অবসান হলো আপাত। এখন খালগুলোকে সবার আগে দখল মুক্ত করতে হবে। আর খালকেন্দ্রিক যোগাযোগব্যবস্থা করা সম্ভব হলে এগুলো দখল হওয়ার সম্ভব হবে না। পাশাপাশি রাজধানীর সড়কে উপরে যানবাহনের চাপ অনেকটা কমবে।

নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আখতার মাহমুদ বলেন, শুধু খাল উদ্ধার ও সংস্কার করলেই এগুলোকে রক্ষা করা যাবে না। এজন্য খালগুলোকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যবহার করতে হবে। 

কারণ, রাজধানীতে দিন দিন জনসংখ্যা বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। কিন্তু সে তুলনায় রাস্তাঘাট বাড়ছে না। তাই সড়কের উপরে চাপ কমাতে রাজধানীর অভ্যন্তরীণ নৌপথ চালু করা গেলে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা ভোগ করবে জনগণ।

তিনি আরো বলেন, খাল যদি আমরা ভালো রাখতে চাই, তাহলে আগে খালের পানিপ্রবাহটা নিশ্চিত করতে হবে। খালের দুপাশে ওয়াকওয়ে তৈরি করতে হবে। কেউ যাতে কঠিন বর্জ্য খালে ফেলতে না পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি খালের পাড়ে সবুজায়ন করতে হবে। কোথাও যদি গণপরিসরের জায়গা থাকে, সেটাও করতে হবে। 

কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, এমনভাবে প্রকল্পপত্র তৈরি করা হয়, তাতে মূল লক্ষ্য গৌণ হয়ে যায়। এগুলো করার পর বাকি কাজগুলোও তখন সহজ হয়ে যাবে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নৌযান চলাচলের যোগ্য করতে এখন চলছে খাল উদ্ধার ও খনন কাজ। পর্যায়ক্রমে শুরু হবে সংস্কার কাজ। প্রতিটি খালে থাকবে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ। দুপাশে থাকবে ওয়াকওয়ে, সাইকেল লেন, সবুজায়ন, ফুডপার্ক, শিশুদের খেলার জায়গা, নান্দনিক বাতি, ফোয়ারা প্রভৃতি। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্র জানায়, খাল উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮৫ কোটি ৪২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। প্রতিটি খালের জন্য পৃথক ব্যয় নির্ধারণ করে একটি প্রকল্পপত্র তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ডিএসসিসি। মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে বাকি প্রক্রিয়া সম্পন্নের ব্যবস্থা নেবে।

এই ব্যয় কমবেশি হতে পারে উল্লেখ করে প্রকল্পপত্র প্রণয়ন কর্মকর্তা ও ডিএসসিসির প্রধান নগর -পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা ধারণামাত্র। এত বড় প্রকল্প ডিএসসিসির নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। সরকার অর্থায়ন করলে পাঁচ বছরের মধ্যেই পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।

ডিএসসিসির তৈরি প্রকল্পপত্রে কালুনগর খাল, জিরানি খাল, মাণ্ডা খাল ও শ্যামপুর খাল উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। ডিএসসিসি এলাকায় এগুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাল। এছাড়া আরো কিছু খাল রয়েছে, সেগুলো ডিএসসিসি নিজস্ব উদ্যোগেই আধুনিকায়ন করতে পারবে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কালুনগর খালের দৈর্ঘ্য ৩ কিলোমিটার, প্রস্থ স্থানভেদে ৭ থেকে ১৫ মিটার। জিরানি খালের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২০ মিটার। মাণ্ডা খালের দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ২ কিলোমিটার। প্রস্থ ৫ থেকে ৪০ মিটার। 

এছাড়া শ্যামপুর খালের দৈর্ঘ্য ৫ কিলোমিটার ও প্রস্থ গড়ে ১২ মিটার। প্রতিটি খালের জন্য প্রয়োজনে কিছু জমি অধিগ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি খালগুলো খনন করে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা হবে।  সেই সাথে হবে আধুনিকায়ন।

প্রকল্পপত্রে কালুনগর খালে থাকবে ৫০০টি নান্দনিক বাতি, ২৫০টি সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল, দুটি ফুডকোর্ট ও কফিশপ, বসার বেঞ্চ ও শেড ৮০টি, ময়লা ফেলার ওয়েস্টবিন ২০০টি,  প্লাজা দুটি, সাইট দর্শনের জন্য দুটি পয়েন্ট, দুটি পাবলিক টয়লেট, দুটি পার্কিং স্পেস, দুটি থাকবে ব্যায়ামাগার। 

এছাড়া ৩০ হাজার বর্গমিটার এলাকায় করা হবে সবুজায়ন। ওয়াকওয়ে হবে ২০ হাজার বর্গমিটারে। বাইসাইকেল লেন হবে ১০ হাজার বর্গমিটার। পাঁচ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে শিশুদের খেলার জায়গা ও  ফোয়ারা, পাম্পহাউস, স্লুইসগেটসহ আরো বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি করা হবে।

জিরানি খালে থাকবে এক হাজার নান্দনিক বাতি, ৫০০টি সোলার প্যানেল, ৪০ হাজার বর্গমিটার সবুজায়ন, চারটি ফুট ওভারব্রিজ, আড়াই হাজার বর্গমিটার সাইকেল লেন, পাঁচটি মাছ ধরার স্থান, চারটি ফুডকোর্ট, একটি প্লাজা, ১০টি বসার বেঞ্চ ও শেড, ১৫০টি ওয়েস্টবিন, পাঁচটি সাইট দর্শনের স্থান, ১০ হাজার বর্গমিটার জায়গায় হবে শিশুদের জন্য ইকোপার্ক, দুটি পাবলিক টয়লেট, দুটি পার্কিং স্পেস, দুটি সেতু, একটি ফোয়ারা প্রভৃতি।

মাণ্ডা খালে এক হাজার ৮০০টি নান্দনিক বাতি বসবে। থাকবে ৮০০টি সৌর প্যানেল, ৫০ হাজার বর্গমিটার এলাকায় সবুজায়ন, ১০ হাজার বর্গমিটার জায়গাজুড়ে ইকোপার্ক, তিনটি পার্কিং, ৩০ হাজার বর্গমিটারে ওয়াকওয়ে, ১০ হাজার বর্গমিটারে সাইকেল লেন, ১৫টি মাছ ধরার স্থান, ছয়টি ফুডকোর্ট, চারটি প্লাজা, ১৪০টি বসার বেঞ্চ ও শেড, ২৫০টি ওয়েস্টবিন, সাতটি সাইট দর্শনের স্থান, দুটি পাবলিক টয়লেট, চারটি ব্যায়ামাগার, ছয়টি ফুট ওভারব্রিজ, চারটি সেতু প্রভৃতি।

শ্যামপুর খালে থাকবে এক হাজার নান্দনিক বাতি, ৫০০টি সৌর প্যানেল, ২০ হাজার বর্গমিটারে সবুজায়ন, ২০ হাজার বর্গমিটারে ওয়াকওয়ে, দুটি ফুডকোর্ট, একটি প্লাজা, ৯০টি বসার বেঞ্চ, ১৫০টি ওয়েস্টবিন, তিনটি সাইট দর্শনের স্থান, পাঁচ হাজার বর্গমিটারে শিশুদের খেলার জায়গা, একটি পাবলিক টয়লেট, একটি পার্কিং, দুটি ব্যায়ামাগার, একটি ফুট ওভারব্রিজ, দুটি ব্রিজ ও একটি ফোয়ারা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সূত্রে জানা গেছে, নগরীর খালগুলো উন্নয়নে আগেই থেকেই বরাদ্দ রয়েছে প্রায় সাড়ে ছয়শ কোটি টাকা। তবে আগের এ অনুমোদিত প্রকল্পপত্রটি সংশোধন করে আরো কিছু বিষয় যুক্ত করা হবে। এতে প্রকল্প ব্যায় প্রায় হাজার কোটি টাকা হয়ে যাবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ঢাকার খালগুলো উদ্ধার করে পানি নিষ্কাশন সচল রাখার পরিকল্পনাসহ নৌরুট স্থাপন করা হবে। খালগুলো যুক্ত হবে নিকটস্থ নদীর সঙ্গে। মূলত খালগুলো হাতিরঝিলের আদলে সাজানোর মহাপরিকল্পনা রয়েছে। খালগুলোকে নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই, যেন ঢাকাবাসীর উপভোগের জায়গা হয়।

তিনি বলেন, ঢাকার খালগুলোর এখনো যে কয়েকটি রয়েছে, অনেকগুলোতে দখল হয়ে গেছে, এরপরেও যেগুলো রয়েছে, সেগুলো যদি আমরা সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারি, রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি, তাহলে পানি নিষ্কাশনে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। 

জিরানি খাল, মাণ্ডা খাল, শ্যামপুর খাল, কালুনগর খাল, তালতলায় একটি খাল আছে, যেটি প্রায় দখল হয়ে যাচ্ছে এবং ধোলাই খাল এই কয়টি খাল নিয়ে আমরা একটি প্রকল্প তৈরি করেছি। আমরা স্থানীয় সরকারের কাছে আমাদের পরিকল্পনা প্রেরণ করব, আমাদের নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দিলে আমরা সেই খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করব।

ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ডিএনসিসি এলাকায় খালগুলোর সীমানা চিহ্নিত করে খালের পাড় থেকে অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদ করে পাড় বাঁধাই, সবুজায়ন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। খাল যাতে কেউ দখল করতে না পারে সেজন্য সিটি জরিপ অনুসারে খালের সীমানা চিহ্নিত করে, খালের দুই পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। 

নৌযান চলাচলের উপযুক্ত করেই খালগুলো খনন  খনন করা হবে। পানির ধারণক্ষমতা বাড়ানো হবে। খালের দুই পাড় বাঁধাই, সবুজায়ন, ওয়াকওয়ে, সাইকেল লেন নির্মাণ করা হবে। 

এছাড়া যেসব খালে জলযান চলাচল করতে পারে সেখানে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!