• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
রিজার্ভ চুরি

অর্থ ফেরত আসেনি ৫ বছরে


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১, ০২:২২ পিএম
অর্থ ফেরত আসেনি ৫ বছরে

ঢাকা : ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের ফেডারেল ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সাইবার জালিয়াতির মাধ্যমে চুরি হওয়া সিংহভাগ অর্থ এখনো ফেরত পায়নি বাংলাদেশ। চুরি হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে বিভিন্ন সময় মাত্র ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ফেরত এসেছে। বাকি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৫৬১ কোটি টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়।

এ ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলা করতেই লেগে যায় ৩ বছর।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘটনা ঘটলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা হয় ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি। মূল আসামি আরসিবিসি ছাড়াও এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য দেশকেও এ মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এদিকে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় করা মামলার তদন্তও শেষ হয়নি গত ৫ প্রায় বছরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদার করা ওই মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার সময় এ পর্যন্ত ৪৬ বার পিছিয়েছে। সবশেষ গেলো গত ১৩ জানুয়ারি মামলার প্রতিবেদন দাখিলের কথা থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা উপস্থিত না থাকায় আদালত বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) পরবর্তী দিন ধার্য করে।

এদিকে, সিআইডি এখন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়ার পর তারা বাংলাদেশে করা মামলার অভিযোগপত্র দেবে।

তদন্তের বিষয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক সিআইডি প্রধান মাহবুবুর রহমান কয়েকটি গণমাধ্যমে জানান, ‘রিজার্ভ চুরির ঘটনায় করা মামলার তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে করা মামলাটি এখনো বিচারাধীন রয়েছে। মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব তদন্তের অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের যেসব নাগরিকদের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত। মামলাটির শুনানি শুরু হতে আরো এক থেকে দুই মাস সময় লাগতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তদন্তে বিলম্বের কারণে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মতে, এই ঘটনায় দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে ফলাফল যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপাইনের আদালতে উপস্থাপন করা গেলে এর ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারতো। ফলে অর্থ ফেরৎ পাওয়া ত্বরান্বিত হতো। কারণ, যে কোনো মামলার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া রয়েছে। রায় যদি বাংলাদেশের পক্ষেও আসে। তারপরও অর্থ ফেরৎ পেতে আরো অনেক সময় লেগে যাবে।

এ প্রসঙ্গে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই মামলার বিচার কাজ কতদিনে শেষ হবে সেটি বলা যাবেনা। এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কারণ অর্থনীতির মামলা ডিক্রি পাওয়ার পরও প্রচুর সময় লাগে সম্পদ জব্দ করতে। শুধুমাত্র জাজমেন্টই মূল কথা না।’

ড. সালেহ উদ্দিনের মতে, চুরি হওয়া অর্থ ফেরৎ আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ভুলপথে হাঁটছে।

তিনি বলেন, ‘কোর্টে না গিয়ে প্রথমেই যদি সেন্ট্রাল ব্যাংক ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে ওদের সাথে দরকষাকষি করতে পারতো তাহলে টাকাটা সহজেই ফেরৎ আনা যেতো। ওদের সেন্ট্রাল ব্যাংক দোষী সাব্যস্ত করতে পারলে সেটি টাকা আদায়ে আরো শক্ত ভূমিকা রাখতে পারতো।

কারণ, ৫০০ কোটি টাকা তাদের জন্য কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা দেশটির সরকারের সাথে আলোচনা না করে আদালতে যাওয়ায় টাকা আদায়ে একটা দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ তৈরি হয়েছে।’

তার মতে, বাংলাদেশের মামলাটির দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা গেলে সেটির ফলাফল ফিলিপাইনসহ অন্যান্য দেশের জন্য সুবিধা হতো। একইসঙ্গে, সিআইডির তদন্তে ধীরগতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মামলার নিষ্পত্তির ওপর ভিত্তি করে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কোর্টে মামলা হলে সেটি ধরে আন্তর্জাতিক কোর্টেও শুনানিতেও অবদান রাখতে পারতো। রায়ের অপেক্ষায় থাকা ঠিক হবে না। যুক্তরাষ্ট্র এবং আমাদের দেশে একসাথে বিচারকাজ চলা উচিৎ। আমাদের তদন্ত আমাদেরই সম্পন্ন করা উচিৎ।’

এদিকে, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য দেশ তাদের দেশের অপরাধীদের শনাক্ত করে বিচারকাজ শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে তদন্তে ধীরগতিসহ জড়িতদের বিষয়ে সুষ্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ না হওয়ায় এ নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের মতে, একটি বিষয় এখনো পরিষ্কার নয়। আর তা হলো, বিদেশিচক্র বাংলাদেশিদের সহায়তা নিয়ে কাজটি করেছে নাকি দেশীয় কোনো চক্র বিদেশিদের সহায়তায় করেছে সেটি এখনো নিশ্চিত না।
একইসঙ্গে, যাদের জড়িত সন্দেহে তাদের পাসপোর্ট জব্দ করাসহ অন্য শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তারা সত্যিকার অর্থেই দোষী কি-না তা বিচারের মাধ্যমেই প্রমাণিত হবে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে কেউ যদি নির্দোষ হয়ে থাকেন তার ওপর অন্যায় করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, ‘দেরির কারণে নানা প্রশ্ন উদ্ভব হচ্ছে। সমগ্র বিষয়টি স্বচ্ছ রাখলে এসব প্রশ্ন উঠতো না। আর যদি সরকার মনে করে প্রকাশ করলে অপরাধীদের ধরতে সমস্যা হবে, তাহলে তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত করা উচিৎ। যাদের সন্দেহ করে পাসপোর্ট সিজ করা হয়েছে, তারা যদি নির্দোষ হয়ে থাকে তাহলে তাদেরকে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের শাস্তি দেওয়া বড় অন্যায়। এটি ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।’

তার মতে, ‘তদন্তটা দেশে এবং বিদেশে দু’জায়গায়ই হতে হবে। এ নিয়ে বিস্তৃত বক্তব্য সরকারের থাকতে হবে। বিশেষ করে কিউসির বক্তব্য। কারণ কিউসি এটি তদন্তের জন্য বাইরে গিয়েছিল। তার রিপোর্টটা কি সেটা প্রকাশ করা উচিৎ।’

তিনি বাইরের তদন্ত কমিটির সাথে বাংলাদেশের তদন্ত কমিটির গিয়ে আলাপ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, যুক্তভাবে বাইরের দোষীদের সাথে কথা বলার সুযোগ চাওয়া উচিৎ।’

সিআইডি সূত্র বলছে, মূলত চারটি দেশের নাগরিক রিজার্ভ চুরির কাজটিতে  সরাসরি জড়িত ছিলেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিকও এই চুরিতে জড়িত ছিল উল্লেখ করে সিআইডির সূত্রটি জানায়, এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অর্থ প্রদানের নেটওয়ার্ক সুইফটে কর্মরত ভারতীয় নাগরিক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!