• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্য পূরণে কাজ চলছে

টার্গেট শত বিলিয়ন ডলারের শ্রমবাজার


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১, ১২:৩৭ পিএম
টার্গেট শত বিলিয়ন ডলারের শ্রমবাজার

ঢাকা : বিদেশে ১০০ বিলিয়ন ডলারের নতুন শ্রমবাজার খোঁজা হচ্ছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এই টার্গেট পূরণের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। এর জন্য প্রয়োজনীয় রোডম্যাপ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

রোডম্যাপ অনুযায়ী, আফ্রিকা অঞ্চলের চারটি দেশে ৪০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে চায় বাংলাদেশ। এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে একডজন দূতকে চিঠি পাঠিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রী। ওই চিঠিতে কর্মসংস্থান তৈরি করতে দূতদের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

বর্তমানে প্রবাসীদের আয় দাঁড়িয়েছে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে। ১০০ বিলিয়ন ডলারের টার্গেট বাস্তবায়ন হলে দেশ নতুন এক উচ্চতায় যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কূটনৈতিকদের দেওয়া চিঠিতে মন্ত্রী ইমরান আহমদ লিখেছেন, সুদানে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ওপরে সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে গবেষণা করে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্য উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় খাত সংক্রান্ত একটি প্রশংসনীয় প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

প্রতিবেদনটি গত ২০ জানুয়ারি ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সেমিনার পেপারে উপস্থাপন করা হয়। সুদানে এরই মধ্যে কাতার, সৌদি আরব, সিরিয়া, জর্ডান, ইয়ামেন, লেবানন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ কৃষি জমি লিজ নিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই চিঠিতে।

এতে আরো বলা হয়, দেশগুলো লিজ নেওয়া জমিতে খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য কৃষিজ ফসল আবাদ করার জন্য নানামুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ওই প্রকল্পে বাংলাদেশি কৃষক ও কর্মী পাঠানোর নতুন সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার তৈরির জন্য দেশগুলোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের চিঠি পাঠানো হয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, কাতার, সৌদি আরব, সিরিয়া, জর্ডান, ইয়ামেন, লেবানন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ একাধিক দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের কাছে কূটনৈতিক চিঠি পাঠিয়ে বিদেশে শ্রমবাজার সৃষ্টিতে সহযোগিতা চেয়েছেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী।

চিঠি পাওয়া রাষ্ট্রদূতদের একজন বলেন, প্রবাসীমন্ত্রী জানিয়েছেন যে সুদানে অনেক দেশ কৃষি খাতে বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশে কৃষি বিষয়ক প্রচুর দক্ষ কর্মী রয়েছেন। তাই যেসব দেশ সুদানে কৃষিকাজ করছে, তারা যেন বাংলাদেশি কর্মীদের কাজে লাগায়, সেটি নিশ্চিত করতে মন্ত্রী যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, এরই মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত সুদানের দূতের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তাদের ওখানে সুযোগ আছে। আমরা এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিদেশে নতুন শ্রমবাজার তৈরির ক্ষেত্রে আফ্রিকা অঞ্চল নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে পরিকল্পনা করছে সরকার। এই অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ একাধিক বিষয়ে সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় পররাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সেখানে যেতে চান না। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী সাফল্য নিশ্চিত করতে হলে আফ্রিকা অঞ্চলে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথ পাড়ি দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে যুক্ত হওয়ার জন্য ‘রূপকল্প ২০৪১’ শীর্ষক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। বিদেশে নতুন শ্রমবাজার তৈরির রোডম্যাপটি এই ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শামসুল আলম জানান, নতুন যেসব দেশে সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়া, উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান। এ ছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকংয়ের কথাও ভাবা হচ্ছে।

তিনি বলেন, মরুভূমির চেয়ে এসব দেশে আবহাওয়া সহনীয়। তাছাড়া এসব দেশে কাজগুলোর ধরন ভালো, শুধু ক্লিনারের কাজ না। বেতনও বেশি আবার শ্রমিকদের অধিকারের পরিস্থিতিও ভালো।

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে রামরু-র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকি জানান, ২০২৫ সাল পর্যন্ত জাপান সারা বিশ্ব থেকে পাঁচ লাখ কর্মী নেবে। বাংলাদেশকে এই বাজারটা ধরতে হবে। যারা জাপানিজ ভাষা জানবে ও সেখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

তিনি আরো জানিয়েছেন, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে দুই হাজারের মতো শ্রমিক বিদেশে কাজে গেছেন। তার মধ্যে আটশই মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশ থেকে তারা বেশি বেতন পাচ্ছেন। তবে সেখানে যেতে হলে কমপক্ষে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা থাকতে হবে। ঠিক কি কাজে সেখানে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা সেটি পরিষ্কার নয়।

তাসনিম সিদ্দিকি আরো বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর একটি বিষয় স্পষ্ট সেটি হলো পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে কর্মী দরকার। তার তথ্যমতে নার্স এবং ল্যাব টেকনিশিয়ানের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। এছাড়া পুরনো গন্তব্যগুলোতেও নতুন কাজের সুযোগ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে।

নারী অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে বিএনএসকে-র নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ইউরোপসহ বহু দেশে বিশেষ করে বয়স্কদের কেয়ার-গিভার বা সেবাদানকারীর চাহিদা অনেক বেড়েছে। শিশুদের দেখভালের জন্য আয়া দরকার হচ্ছে। বাংলাদেশের যেসব নারীরা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর কাজ করছেন তারা ইতিমধ্যেই এ ধরনের নার্সিংয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

তিনি আরো বলেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোতে মানুষের গড় আয়ু বেশি তাই বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি। এসব দেশে প্রচুর বয়স্ক ব্যক্তি একা থাকেন অথবা বয়স্কদের কোনো বিশেষায়িত আবাসনে থাকেন। যুক্তরাজ্যে ইতিমধ্যেই অনেক বাংলাদেশি নারী, বয়স্ক ও শিশুদের সেবাদানকারী হিসেবে কাজ করছেন।

সুমাইয়া ইসলাম বলেন, যারা মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী, বিমানবন্দর, রাস্তা ও শপিং মলে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেন তারা খুব সহজেই হোটেলে নানা কাজ করতে পারবেন। যে মেয়েটি মধ্যপ্রাচ্যে কারো বাড়িতে বাথরুম আর কাপড় পরিষ্কার করে সে হোটেলেও হাউস-কিপিংয়ের কাজ সহজেই করতে পারবে। যারা করোনাভাইরাসের জন্য চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরত এসেছেন তাদের স্কিল ডাইভার্সিফাই করে সহজেই এসব পেশায় পাঠানো সম্ভব। দোকানে সেলসেও এসব মেয়েদের কাজে লাগানো যেতে পারে।

জাপানের সাথে বাংলাদেশের একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল বলে জানিয়েছেন মো. শামসুল আলম।

তিনি বলেন, ‘আই অ্যাম জাপান’ নামে একটি কোম্পানি ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করছে। তারা ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়ে, কর্মী নির্বাচন করে জাপানে বিভিন্ন কোম্পানি, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরির কাজ নিজেরাই শিখিয়ে নিয়োগ দিচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়াতে সরকারিভাবে ইতিমধ্যেই অনেকে গেছেন। বাংলাদেশি কর্মীদের সেখানে কাজের জন্য ইপিএস নামে বিশেষ ভিসা রয়েছে।

সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস প্রশিক্ষণ দিয়ে ইতিমধ্যেই অনেককে দক্ষিণ কোরিয়া পাঠিয়েছে। যারা নানা কোম্পানি ও উৎপাদনকারী কারখানায় কাজ করছেন। জাপানের মতো দক্ষিণ কোরিয়াও নিজেরা ভাষা ও দক্ষতা তৈরি করে, খরচ দিয়ে বাংলাদেশে কর্মী নেয়।

তিনি আরো বলেন, আরো কর্মী নিতে আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে স্যামসাং ও দাইয়ুর মতো প্রতিষ্ঠানের কারখানায় বাংলাদেশিরা কাজ করছেন। কৃষিতেও কাজ করছেন বাংলাদেশিরা।

তবে নতুন দেশগুলোতে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি বলে মনে করেন শামছুল আলম। তিনি বলেন, কেউ যেন দেশগুলোর নাম শুনেই যাওয়ার চেষ্টা না করে। কুচক্রী মহলের পাল্লায় পড়ে মানবপাচারের শিকার যেন না হয় এজন্য আমরা দেখে শুনে এগুচ্ছি।

কর্মীদের নতুন ধরনের দক্ষতা দরকার, বলছেন অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন বিশেষজ্ঞরা। নতুন গন্তব্যের যেসব দেশগুলোতে সুযোগ রয়েছে সেখানকার ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছেন অভিবাসীদের নিয়ে যারা কাজ করেন তারা। সেই সাথে ইংরেজি।

এছাড়া বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা, যেমন ওয়েল্ডিং, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী মেরামত, গাড়ি মেরামত, বৈদ্যুতিক কাজের শিক্ষা মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় থেকেই শুরু করার কথা বলছেন তারা।

নার্স ও ল্যাব টেকনিশিয়ান তৈরিতে বেসরকারি খাতের সাথে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারের প্রশিক্ষক কেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত বলে তিনি মনে করেন তারা। কৃষিকাজে যোগ দিতে হলে কৃষি যন্ত্রপাতি, গাছের আধুনিক উপায়ে পরিচর্যা, গাছ ও তার মৌসুম সম্পর্কে শিখানোর প্রশিক্ষণের কথাও তারা বলছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!