• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিজ সক্ষমতায় চলবে দেশ


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৯:৪৩ পিএম
নিজ সক্ষমতায় চলবে দেশ

ঢাকা : আর নয় অন্যের দয়া। এখন থেকে নিজ সক্ষমতায় চলবে বাংলাদেশ। যদিও এজন্য আমাদেরকে বেশকিছু কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। তবে আমরা কোনো কিছুকেই ভয় পাই না। আমরা যে সব চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে পারি তার প্রমাণ অসংখ্যবার পেয়েছে বিশ্ববাসী। 

গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। 

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় সুখবর এসেছে-স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটে উন্নয়নশীল দেশের কাতারভুক্ত হলো বাংলাদেশ। এখন আর কেউ বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি বলতে পারবে না।

গত শুক্রবার রাতে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় প্ল্যানারি সেশন শেষে মূল্যায়নে বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল ও লাওসকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করা হয়। বাদ দেওয়া হয় মিয়ানমারকে। নিউইয়র্কে সিডিপির পাঁচ দিনব্যাপী ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভা শেষে এ ঘোষণা আসে। এর মধ্যদিয়ে নতুন ইতিহাস ‍সৃষ্টি করল বাংলাদেশ। পদার্পণ করল নতুন যুগে। 

দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও সরকারি নীতি নির্ধারকরা বলছেন, এই অর্জন বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক ও গর্বের। তবে এর মধ্যদিয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

বিশ্লেষকদের মতে, এ উত্তরণ জাতি হিসেবে আত্মতৃপ্তি এবং মর্যাদার। একই সঙ্গে এটি কঠিনতম চ্যালেঞ্জেরও। উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে আগামীতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। থাকবে না রপ্তানিতে শুল্ক সুবিধা। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় অর্জন ব্যাহত হবে। রেয়াতি ঋণ সুবিধা মিলবে না, বাড়বে কর্মসংস্থানের ঝুঁকি, মেধাস্বত্ব সুবিধা উঠে যাবে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে অসম প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করতে হবে। কমবে প্রবাসী আয় এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমার ঝুঁকি বাড়বে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ও শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উত্তরণের মধ্য দিয়ে পাওয়া এসব চ্যালেঞ্জের মূলবার্তা হলো- আগামীতে বাংলাদেশকে নিজের সক্ষমতা দিয়েই চলতে হবে। কারো দয়ায় আর নয়। এখানে চ্যালেঞ্জের মূলকারণ হচ্ছে, কারোনা মহামারীর কারণে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিবেশ-পরিস্থিতি অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনুকূলে নয়। এ বৈরী পরিবেশের মধ্যদিয়েই আমাদেরকে নিজের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। 

আরেক শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উত্তরণের সুফল বহুমাত্রিক। তবে সেটি আমরা কতটা মসৃণভাবে ভোগ করতে পারব, তা নির্ভর করছে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত সেই সক্ষমতা প্রমাণের ওপর।

এই উত্তরণে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা আসবে রপ্তানি খাতে-এমনটাই মনে করছেন বাণিজ্য বিশ্লেষকরা। নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা বাংলাদেশের। কিন্তু উত্তরণ প্রক্রিয়াকে মসৃণ ও টেকসই করা এবং করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সিডিপি বাংলাদেশকে বাড়তি দুই বছর সময় দিয়েছে। সেই হিসাবে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের আনুষ্ঠানিক মর্যাদা পাবে বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এস মনসুর বলেন, এই উত্তরণ আমাদের জন্য বড় অর্জন। তবে এতে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা এখনো দুর্বল। তবে প্রস্তুতি পর্বের জন্য যে সময় পাওয়া গেছে তা কাজে লাগিয়ে শিল্পখাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছানোয় বাংলাদেশকে কিছু সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজশর্তে ও কমসুদে আর ঋণ পাওয়া যাবে না। উন্নয়ন প্রকল্পে দাতাদেশ ও সংস্থাগুলোর বিনা সুদের ঋণ এবং অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাংলাদেশকে উচ্চসুদে ঋণ নিতে হবে। 

স্বল্প রাজস্ব আয় দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে। এ প্রক্রিয়ার সঠিক সমন্বয় না হলে অভ্যন্তরীণ অর্থব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়বে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই উত্তরণের পর প্রবৃদ্ধিতে পতন দেখা গেছে। বৈদেশিক সাহায্য এবং রেমিটেন্সেও পতন ঘটে। ফলে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর একটা নতুন চাপ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কর আদায়ের পরিমাণ না বাড়লে এ সমস্যা আরো জোরালো হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ে এখনো দুর্বলতা থাকায় বিদেশি ঋণের প্রয়োজন আছে। এ জন্য আমাদের বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে।

শুল্কমুক্ত সুবিধাও আর থাকবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ এলডিসি হিসেবে ইউরোপের বাজারে এভরিথিং বাট আর্মস (ইভা) কর্মসূচির আওতায় রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর এই সুবিধা থাকে না। এ কারণে প্রতি ১০০ টাকার রপ্তানিতে আগের চেয়ে সাড়ে ৭ টাকা বেশি খরচ দিতে হবে। আমাদের আয় কম হবে। প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এটা দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রবল ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

ইউনাইটেড ন্যাশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) জরিপে উল্লেখ করা হয়, রপ্তানি আয় ৫.৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ফলে প্রতি বছর মোট রপ্তানি আয়ের দেড় বিলিয়ন থেকে ২.২ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশকে হারাতে হতে পারে। সে জন্য এখন থেকেই রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্রীকরণসহ প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সিডিপি তিনটি সূচকের মানের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা মূল্যায়ন করে। সূচকগুলো হলো-মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা। তিনটি সূচকেই উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। 

২০১৮ সালের মার্চে প্রথম দফায় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। নিয়ম হচ্ছে, এলডিসি থেকে বের হতে জাতিসংঘের সিডিপির পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পেতে হয়।

জাতিসংঘের সিডিপির দ্বিতীয় দফার বৈঠকেও বাংলাদেশ প্রতিটি সূচকেই প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। স্বীকৃতি পাওয়ার পর প্রস্তুতির জন্য তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ নিয়ে গত ১২ জানুয়ারি জাতিসংঘের সিডিপির এক্সপার্ট গ্রুপের ভার্চুয়াল সভায় বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে আসা নতুন চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে সরকার। এসব বিষয় পর্যালোচনা করে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে সিডিপি।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে উন্নয়নের যে নীরব বিপ্লব শুরু হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় উন্নয়নশীলে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে। 

জাতিসংঘের দেওয়া এ স্বীকৃতি সরকারের আগামী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে আরো বেশি গতিশীল করবে। যেসব চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আসতে পারে সেগুলো সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা ঠিক করে উত্তরণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া ২০১৮ সাল থেকেই শুরু করেছে সরকার। আশা করছি, সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো সাফল্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করতে পারব।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!