• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দূষণে রুগ্ণ সুন্দরবন


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৮, ২০২১, ০৪:১৯ পিএম
দূষণে রুগ্ণ সুন্দরবন

ঢাকা : গোটা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনে, এমনকি বঙ্গোপসাগরেও। গত কয়েক দশকের ব্যবধানে অনেক প্রাণী আজ বিলুপ্ত। টিকে থাকার লড়াইয়ে জাতীয় প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে।

মানুষের লোভেও বার বার ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ এ অরণ্য। বন-বাদাড় কেটে তৈরি হয়েছে মাছের ঘের। জঙ্গল সাফ করে গড়ে উঠছে বসতি। বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে চলছে চাষাবাদ।

অথচ কতবার যে ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বনটি দেশকে রক্ষা করেছে; তার কোনো হিসাব নেই। শুধু তাই নয়, দেশের অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান অপরিসীম।

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে লবণাক্ততার সমস্যা আগে থেকেই ছিল। এবার যুক্ত হয়েছে পানিদূষণ। একইসাথে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে পশুর নদ খনন, বন্যপ্রাণী ও বিষ দিয়ে মাছ শিকার, মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, ভূমিক্ষয় ও ভাঙন, নৌ-যান চলাচল, পর্যটকদের অসচেতনতা, নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অত্যাচার, অবকাঠামো নির্মাণ ও তার পাশেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বনটিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ধীরগতিতে হলেও বাড়ছে পানি ও মাটির দূষণের মাত্রা, দীর্ঘমেয়াদে যা মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।

কেননা গেল ১০ বছরেই সুন্দরবনে প্রায় সাতগুণ দূষণ বেড়েছে বলে তথ্য মিলেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায়। বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী জানান, শিল্প কারখানা স্থাপন ও যান্ত্রিক নৌযান চলাচলের কারণে  

সুন্দরবনের গাছপালা, বন্য ও জলজপ্রাণীর ওপর বেশ প্রভাব পড়ছে। বনের বুক চিড়ে বয়ে চলা নদ-নদীর পানি ও মাটিতে দূষণ বেড়ে যাওয়ায় অনেক জায়গায় আগের মতো আর গাছের চারা গজাচ্ছে না। তাছাড়া পানিতে তেলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজপ্রাণী।

এই গবেষক আরো বলেন, ‘পশুর নদের প্রতি লিটার পানিতে ২০১০ সালের দিকে তেলের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ছয়গুণ, ৬৮ মিলিগ্রামে। অথচ স্বাভাবিক মাত্রা হলো ১০ মিলিগ্রাম। সব মিলিয়ে দূষণের কারণে ইউনেস্কো ঘোষিত পৃথিবীর অন্যতম হেরিটেজ সুন্দরবন আজ ভয়াবহ হুমকির মুখে।’

২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে ট্যাঙ্ক ডুবির কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে সুন্দরবন। এরপর বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীতে পটাশ, কয়লা ও ক্লিংকারবোঝাই জাহাজডুবির ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকবার। আবার অভিযোগ রয়েছে, সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিন ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি চক্র। এতে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া, সাপ, ডলফিন, শুশকসহ জলজপ্রাণি মারা যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে পাচারের উদ্দেশ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে বাঘ-কুমিরও।

এদিকে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বেড়েছে প্লাস্টিকের দূষণ। পর্যটকরা সাথে করে নিয়ে আসা পানির বোতল, খাবার প্যাকেট, পলিথন, প্লাস্টিকের প্লেট, চায়ের কাপসহ বিভিন্ন বর্জ ফেলে যাচ্ছেন স্পটগুলোতে। আর এসব জোয়ারের পানিতে নদীতে মিশে সমুদ্রেও চলে যাচ্ছে। এছাড়া উচ্চশব্দে গান বাজানো হয় পর্যটকবাহী নৌযানে। বনের মধ্যেও হৈচৈ করতে দেখা যায় অনেক পর্যটককে। এর সবকিছুর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বনের ওপর।

ইউনেস্কোর পরামর্শক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) এক প্রতিবেদন বলছে, সুন্দরবনের মিঠাপানির প্রবাহের সবচেয়ে বড় উৎস গঙ্গা নদী। সত্তরের দশকে ওই নদীর ওপরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটির এলাকা সুন্দরবনে মিঠাপানির প্রবাহ কমে আসে ও এতে লোনাপানির প্রবাহ বেড়ে যায়। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ার ফলে নদীগুলোতে পলি বেড়ে গেছে।

এতে সুন্দরবনের বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর বসতি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক ধরনের উদ্ভিদ উচ্চ লবণাক্ততা সহ্য করতে না পেরে মারা যাচ্ছে।

পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের বায়ু, পানি ও মাটিদূষণ বাড়বে। কয়লা পরিবহনের জন্য নৌপথ চালু রাখতে পশুর নদ খনন করায় সেখানকার ছয় প্রজাতির ডলফিন ও কুমির আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

১৯৯৯ সালে বনটির চারপাশের ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ বা ইসিএ ঘোষণা করা হয়। আর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ইসিএতে যেকোনো ধরনের কারখানা নিষিদ্ধ।

যেখানে খোদ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকেই আদালতে উপস্থাপিত এক নথিতে বলা হয়, সুন্দরবনের আশপাশে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০টি শিল্পকারখানা স্থাপনের বৈধ অনুমতি রয়েছে। প্রকৃত পরিস্থিতি আরো নাজুক। গত আট-দশ বছরেই গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান।

এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট কারখানা, এলপি গ্যাস প্ল্যান্ট, অয়েল রিফাইনারি, বিটুমিন, সি ফুড প্রসেসিংয়ের মতো বিপজ্জনক কারখানা। আর এগুলোর অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পশুর নদে, যা পরবর্তীতে স্রোতের সাথে চলে যাচ্ছে সুন্দরবনের মধ্যে। তাতে দূষিত হচ্ছে পানি ও মাটি।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার ২০১০ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল সুন্দরবনে। সেই প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, এই অঞ্চলের ৭০ শতাংশ ভূমি সমুদ্রের উপরিভাগের মাত্র কয়েক ফুট ওপরে।

আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়তই, যার জেরে কমে আসছে রয়েল বেঙ্গলের প্রজননক্ষেত্র। একইসাথে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না বাংলার বাঘ। তার ফলে কমছে প্রজনন ক্ষমতাও। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ ইঞ্চির মতো বৃদ্ধি পেলেই কয়েক দশকের মধ্যে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে আসতে পারে ৯৬ শতাংশ।

আরো এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের ফলে বিশ্বের বিপন্নপ্রায় স্তন্যপায়ী প্রাণিকুলের প্রায় অর্ধেক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনে। দূষিত হচ্ছে মাটি ও বাতাস। ক্রমাগত কমছে উপকূলের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত সুন্দরী গাছ। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও প্রাণিকুলেও।’

এই গবেষক আরো বলেন, ‘সুন্দরী গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় সমুদ্রের ঝড় তাতে বাঁধা পায় ও সেটি দুর্বল হয়ে স্থলভাগে আছড়ে পড়ে। বিশাল ক্ষতি থেকে রক্ষা পাই আমরা; কিন্তু আশঙ্কাজনকহারে বনের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বাড়ায় মারা যাচ্ছে অনেক সুন্দরী গাছ। নোনা পানিতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে এ গাছের বীজ। প্রকৃতির বৈরিতায় কমছে উচ্চতাও।’

তবে এখনো সচেতন হলে হয়তো খানিকটা প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচানো সম্ভব; কিন্তু এ সময়টাও চলে গেলে তখন আর বিপদের শেষ থাকবে না।

এ প্রসঙ্গে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘গায়ের জোরে যতই ঢোল পেটানো হোক, দেশকে যা বিপন্ন করে তা কখনোই উন্নয়ন নয়। রামপালসহ মানুষ ও প্রকৃতিবিধ্বংসী প্রকল্পগুলোই তার দৃষ্টান্ত।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!