• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
রাজনীতিতে অনীহাকে দায়ী করছেন নেতারা

এক যুগেও হয়নি নারী কোটা পূরণ


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৯, ২০২১, ০৪:৩১ পিএম
এক যুগেও হয়নি নারী কোটা পূরণ

ঢাকা : একটা সময় মনে করা হতো নারী মানে অন্তপুরের বাসিন্দা। সে ঘরকন্না করবে, বাচ্চা সামলাবে। পড়াশোনা করলেও তার পক্ষে বাইরে গিয়ে চাকরি করতে চাওয়াটা অন্যায় আবদার ছাড়া আর কিছুই নয়। নারী রাজনীতি করবে, নেতৃত্ব দিবে এটাতো ছিল আকাশ-কুসুম কল্পনা। যদিও নারী এখন আর অন্তপুরের বাসিন্দা নয়। নারী এখন রাঁধে, চুল বাঁধে, চাকরিও করে।

সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারী বিচরণ করছে সাফল্যের সঙ্গে। আর আমাদের দেশে নারী রাজনীতিকরা বরাবরই যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে সংসদ নেত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং স্পিকার-তিনজনই নারী। তারা বেশ দক্ষতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে রাজনীতিতে বা নেতৃত্বে নারীর সংখ্যা আশানুরূপ নয়।

২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ে কমিটিতে নারী নেতৃত্ব ৩৩ শতাংশ করাসহ বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০০৮ সালে ইসির নিবন্ধন পায় রাজনৈতিক দলগুলো। অন্য শর্তগুলোর মধ্যে ছিল বার্ষিক অডিট রিপোর্ট ইসিতে জমা দেওয়া, ছাত্র-শ্রমিক বা পেশাজীবী সংগঠনকে দলের সহযোগী সংগঠনের মর্যাদা না দেওয়া ইত্যাদি। এসব শর্তগুলোর মধ্যে অন্যগুলো পূরণ হলেও এক যুগেও প্রধান তিনটিসহ কোনো দলই নারী নেতৃত্ব কোটা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি।

রাজনৈতিক দলের নারী নেতৃত্বে বিষয় আরপিওতে বলা হয়েছে, যদি কোনো দল নিবন্ধিত হতে চায়, তবে নিম্নলিখিত শর্তগুলোর মধ্যে একটি হলো-কেন্দ্রসহ সব পর্যায়ের কমিটিতে নারীদের জন্য কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে এবং ধারাবাহিকভাবে ২০২০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। হাতে গোনা দু-একটি দল ছাড়া এ পর্যন্ত কেউ ২০ শতাংশেরও বেশি নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি।

এ অবস্থায় কমিশন রাজনৈতিক দল থেকে মতামত নিয়ে আইন সংশোধন করে ২০৩০ সাল করার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। আইনটি কয়েক দফা চালাচালি করে এখন ভেটিং পর্যায়ে রয়েছে।

বর্তমানে রাজনৈতিক দলে নারী নেতৃত্বের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়-ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ২৪ শতাংশের কম নারী রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে এই চিত্র আরো ভয়াবহ। বিএনপির ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর যে কমিটি ঘোষণা করে তাতে ৫২১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে নারী রয়েছেন ৬৮ জন (১৩ শতাংশ)।

অবশ্য আরপিওর শর্তপূরণ বিষয়ে ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশনে যে চিঠি দিয়েছিল তাতে বলা হয়-দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ১৫ ভাগ নারী সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে বর্তমানে নারী নেতৃত্বের হার কম বেশি ১০ শতাংশ। যদিও দলটি ইসির চিঠির জবাবে জানিয়েছিল তাদের দলের নারী নেতৃত্ব ২০ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য দলের মধ্যে সিপিবিতে ১৩.৩৩ শতাংশ ও জাসদে, ১১.৯২ শতাংশ নারী নেতৃত্ব রয়েছে।

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল গণফ্রন্ট জানিয়েছে, তাদের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। ইসিতে দেওয়া তথ্যের আলোকে এনপিপির ২০ শতাংশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৬, গণতন্ত্রী পার্টিতে ১৫ শতাংশ ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ১ নারী নেতৃত্ব রয়েছে। জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) ১০১ সদস্যের কোর কমিটিতে ১৬ জন নারী। অর্থাৎ কমিটিতে নারী আছেন ১৫.৮ শতাংশ। লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলিডিপির) কমিটিতে নারী আছে ২২ শতাংশ। তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর গড়ে ৩-৪টি করে নারী উইং রয়েছে-যাদের শতভাগই নারী নেতৃত্ব রয়েছে।

প্রধান বিরোধীদল জাপা কাগজে কলমে দলের নারী নেতৃত্ব ১২ শতাংশ দেখালেও বাস্তবে আরো কম। দলটির সব স্তরে বেশির ভাগ পদই আগলে রেখেছে পুরুষরাই। তবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকে নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া শর্ত পূরণে দলের সব কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব নিশ্চিতের চেষ্টা করছেন বলে জানান দলটির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি।

এক যুগেও কেন নির্বাচন কমিশনের শর্তপূরণ করা যায়নি-জানতে চাইলে সোমবার (৮ মার্চ) সকালে তিনি বলেন, শুধু আমরাই নয়,  আমরা জানা মতে কোনো দলই এই কোটা পূরণ করতে পারেনি। তারপরও আমরা বসে নেই। শুধুমাত্র ইসির কোটা পূরণ নয় বরং জাতীয় পার্টিতে পুরুষের সমান নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, কমিটিতে ৩৩ শতাংশ কোটা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীদের অনীহা। কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা সর্বত্র দেখা গেছে নারীরা নেতৃত্বে আসতে চায় না। গ্রামেগঞ্জের নারীরা রাজনীতিতে আসতেই চান না।  তাছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক বাধা তো আছেই।  এসব বাধাবিপত্তি মোকাবিলা করে আমরা চেষ্টা করছি নারীদের বিশেষ করে শিক্ষিত নারীদের দলে নিয়ে আসতে।  আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছি। ইতোমধ্যে দলের সব স্তরের কমিটিতে নারী নেতৃত্ব বেড়েছে। নারীরা দলীয় কমিটিতে ভালো কাজও করছেন।

নারীর ক্ষমতায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী পদ পূরণ নিশ্চিত করা সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জিএম কাদের। বলেন, এটি অবশ্যই ইতিবাচক। নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসির এই টার্গেট বড় ভূমিকা রাখবে। রাজনীতিতে নারীদের প্রতিষ্ঠা ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন অসম্ভব। আমি মনে করি, সব দলে নারী নেতৃত্ব বাড়ানো উচিত।

রাজনৈতিক দলের নারী নেতৃত্বে নিশ্চিতের বিধান সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, আইনে বলা আছে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চেষ্টা করবেন। এটা বাধ্যতামূলক কোনো ধারা ছিল না। এটা ছিল ঐচ্ছিক। রাজনৈতিক দলগুলো এটা কতটুকু করতে পেরেছে, এটা আদৌ করা সম্ভব হবে কিনা? ঐচ্ছিক ধারার কতটুকু প্রয়োজনীয়তা আছে-সবকিছুর বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার।

 রাজনৈতিক দল বা সরকার যদি মনে করে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তাহলে উনারা রাখবেন। উনারা যদি মনে করেন সময় বাড়িয়ে ২০২৫ বা ২০৩৫ সাল করা দরকার তাহলো তা এক্সটেন করবেন। এটা হতে হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। নির্বাচন কমিশন থেকে এ বিষয়ে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়াটা কোনোক্রমেই ঠিক হবে না। কমিশন এই আইনটি তৈরি করেছে। এটা সরকারের আইন। আমরা কেবল মতামত দিয়ে বাস্তব অবস্থা উনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি।

কমিশনার কবিতা খানম বলেন, ২০১৮ সালে আমরা রাজনৈতিক দলে নারী নেতৃত্বের সর্বশেষ অবস্থার তথ্য নিয়েছিলাম। সেখানে প্রত্যাশিত মাত্রায় না হলেও বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গেছে। শিগশিরই আমরা আবারো তথ্য সংগ্রহ করবো। এটা পাওয়ার পর দলগুলোতে নারী কোটার সর্বশেষ পরিস্থিতি বিস্তারিত বলতে পারবো।

শর্তের সময় পার হলেও আইনি ব্যত্যয় হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, আইনটি এখনো হয়নি। তবে  আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছি। সেই প্রস্তাব তো নাকচ হয়নি। যতক্ষণ নাকচ না হবে ততক্ষণ তো আমরা বলতে পারি না যে এটা আইনের বাইরে চলে গেছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!