• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে রোগীর চাপ, মিলছে না আইসিইউ বেড


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ৫, ২০২১, ০৫:৩৩ পিএম
বাড়ছে রোগীর চাপ, মিলছে না আইসিইউ বেড

ঢাকা : রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা ওরফাতুন নেছাকে। করোনা, হূদরোগসহ নানা জটিলতা দেখা দেওয়ায় স্বজনরা তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করেন। বারডেমের ৮২ নম্বর ওয়ার্ডের ৮৩১ নম্বর বেডে ছিলেন তিনি। চিকিৎসকরা তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন। স্বজনরা প্রথমে বারডেমে চেষ্টা করে আইসিইউ পাননি। পরে তাঁরা যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতালে। সবখানেই সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। এই অপেক্ষার মধ্যেই মারা যান ওই রোগী।

ওই রোগীর এক স্বজন বলেন, ‘এক বছরে আইসিইউ নিয়ে এত কিছু হলো, তারপরও এখন আমরা আইসিইউ সেবা না পেয়ে প্রিয় স্বজনকে হারালাম; এর দায় তো সরকারকেই নিতে হবে। আমরা ঢাকা মেডিকেলেও দৌড়ঝাঁপ করেছি। কিন্তু লাভ হয়নি, আইসিইউ পাইনি।’

বাড়তি টাকা, ঘুষ এমনকি নেতা মন্ত্রীর তদবিরেও মিলছেনা (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) আইসিইউ বেড। সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আইসিইউ ছাড়াও করোনা রোগীর চিকিৎসায় হাসপাতালে ভর্তি করাও যাচ্ছেনা। সব হাসপাতালেই অতিরিক্ত রোগী।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নাজমুল হক সাংবাদিকদের বলেন, অবস্থা খুব শোচনীয়। একে তো আইসিইউ বেড নেই তারপর রোগীর চাপ। সবমিলিয়ে এখন মুমূর্ষু রোগী ছাড়া ভর্তি করা সম্ভব না।

গত ৩০ মার্চ থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ৫ দিনে ২৯ হাজার ৩৮২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৬৪ জন। সর্বশেষ তথ্যমতে, গত একদিনে আক্রান্ত হন ৫ হাজার ৬৮৩ জন। মারা যান ৫৮ জন। তার আগের দিনের আক্রান্ত হন ৬ হাজার ৮৩০ জন, মারা যান ৫০ জন।

১ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, একদিনে ৬ হাজার ৪৬৯ জন, মারা যান ৫৯ জন। ৩১ মার্চ জানানো হয়, আক্রান্ত ৫ হাজার ৩৫৮ জন, মৃত্যু ৫২ জন এবং ৩০ মার্চ ৫ হাজার ৪২ জন আক্রান্তের দিনে মারা যায় ৪৫ জন।  সবমিলিয়ে গত এক সপ্তাহে পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর হার ৭১ শতাংশ। আর আক্রান্তের হার ৬৬ শতাংশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে করোনার রোগীর সংখ্যা আসন সংখ্যার চেয়েও দ্বিগুণ। ফলে নতুন রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না।

গত ২৩ মার্চ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবনের করোনা ইউনিটের বেড খালি না থাকায় নতুন রোগীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

ঢামেকের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাফিজ সরকার বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। আমাদের হাসপাতালেও ভর্তি হচ্ছে প্রচুর রোগী। হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলা থেকে ১০তলা পর্যন্ত করোনা রোগী ভর্তি হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে রোগীর সংখ্যা কম ছিল। বেড খালি না থাকায় নতুন রোগীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, নতুন ভবনে করোনা সাসপেক্টেড রোগীদের ভর্তি করে আলাদা রাখা হয়। এছাড়া করোনা রোগীদের সরাসরিও ভর্তি করা হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ সরকার বলেন, নতুন ভবনের করোনা আইসিইউ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই ইউনিটটি এখনও তালা বন্ধ। ওই আইসিইউর পাশে একটা পিসিসিইউ আছে। সেটাকে এইচডিইউ করে রোগীদের রাখা হচ্ছে। আগের নিয়মেই চিকিৎসকরা ডিউটি করছেন। আপাতত চিকিৎসক সংকট নেই। সংকট শুধু জায়গার। নতুন রোগীদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। প্রচুর রোগী। কেউ চিকিৎসা শেষে বাড়ি গেলে তারপর অন্য রোগীকে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে।

নতুন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার মো. রিয়াজ বলেন, সাসপেক্টেড ওয়ার্ডে কয়েকটি বেড খালি থাকলেও করোনা ইউনিটে কোনো বেড খালি নেই। আনুমানিক নতুন ভবনে সাড়ে ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে।

ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, করোনা রোগীর সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গেছে। আমরা সবাইকে শয্যা দিতে পারছি না। যারা খুবই ক্রিটিক্যাল রোগী তাদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া করোনা আক্রান্ত সব রোগীকেই অক্সিজেন দেওয়া হয়। আমাদের সেন্ট্রাল অক্সিজেনের মাধ্যমে সবাই অক্সিজেন পেয়ে থাকে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। আমাদের চিকিৎসকসহ স্টাফদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এছাড়া প্রচুর রোগী আসছেন। এত শয্যা আমরা পাবো কোথায়? আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি।

নাজমুল হক বলেন, অন্যান্য ওয়ার্ডে বেড খালি না থাকলেও রোগীদের ফ্লোরে ও আনাচে-কানাচে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হতো। কিন্তু করোনা রোগীদের তো আর ফ্লোরে রাখা হয় না। যতগুলো বেড আছে ততগুলো রোগী ভর্তি নেওয়া হয়।

তিনি বলেন, হাসপাতালের বার্ন ইউনিটকে করোনা সার্জারি ইউনিট করা হয়েছে। যাদের দ্রুত সার্জারি দরকার দেখা গেল সে করোনা আক্রান্ত। সেসব রোগীকে সেখানে ভর্তি করে সার্জারি করা হচ্ছে। সেখানেও করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

ঢামেক হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, রোগীর সংখ্যা এখন প্রচুর। আমাদের প্রতিদিন প্রচুর স্যাম্পল সংগ্রহ করতে হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে কিছুটা কমে গিয়েছিল। ওই সময় প্রতিদিন মেশিন রান করত একবার আর এখন রান করে তিনবার। একবার রান করার সময় ৯৬টি স্যাম্পল দেওয়া হয় মেশিনে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রোগীর ধারণক্ষমতার বেশি চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে আইসিইউ বেড খালি নেই। ক্রিটিক্যাল রোগী ছাড়া এখানেও ভর্তি নিচ্ছেনা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫০০ শয্যা হাসপাতালটির কোভিডের জন্য ২৫০ ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে ৪৫০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। অপরদিকে মুগদা, কুয়েত মৈত্রীসহ অন্যান্য হাসপাতালেরও একই অবস্থা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রোগী বেড়ে যাওয়ার কারণে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারকে অস্থায়ীভাবে করোনা হাসপাতাল করার পরিকল্পনা চলছে। চলতি সপ্তাহেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এমনতিও করোনা আক্রান্তদের ভর্তিতে সমস্যা তারওপর আইসিইউ করুণ অবস্থা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-এর জন্য এক মন্ত্রীকে দিয়ে ফোন করানোর পরও তিনি আইসিইউ বেড পাননি।

রাজধানীতে করোনা ডেডিকেটেড ঘোষিত হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যার সংখ্যা ১০৮টি। তার মধ্যে ১০৮টি শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে।

বেসরকারিভাবে করোনা ডেডিকেটেড ৯টি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১৮৮টি। তার মধ্যে রোগী ভর্তি রয়েছে ১৪৪টিতে।

জানা যায়, বেসরকারি হাসপাতালে একটি আইসিইউ বেডে প্রতিদিন অর্ধলাখের বেশি টাকা বিল পরিশোধের কথা শুনে অনেকে সেখানে রোগী ভর্তি করাতে সাহস পান না।

রাজধানীর ১০টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ১৬টি আইসিইউ শয্যার ১৬টিতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ১৬টি শয্যার ১৬টিতে, ৫০০ শয্যার কুর্মিটোলা হাসপাতালের ১০টি শয্যার ১০টিতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০টি শয্যার ১০টিতে, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয়টির ছয়টি, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ১৯টি শয্যার ১৯টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছেন।

২৫০ শয্যার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টির মধ্যে ১৬টিতে, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টির মধ্যে ১৩টিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন।

অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ১৮৮টি শয্যায় রোগী ভর্তি ১৪৪টিতে। আইসিইউ শয্যা ফাঁকা মাত্র ৪৪টি। নয়টি হাসপাতালের মধ্যে ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের ৩০টি আইসিইউ বেডের ২২টিতে, আসগর আলী হাসপাতালে ৩২টির ২০টিতে, স্কয়ার হাসপাতালের ১৯টির ১৩টিতে, ইবনে সিনা হাসপাতালের পাঁচটির চারটিতে, ইউনাইটেড হাসপাতালের ২২টির ১৪টিতে, এভার কেয়ার হাসপাতালের ৪০টির ৩৪টিতে, ইমপালস হাসপাতালের ৩৫টির ৩২টিতে, এ এম জেড হাসপাতালের ১০টির আটটিতে এবং বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের নয়টির নয়টিতেই রোগী ভর্তি রয়েছেন। রাজধানীর বেসরকারি নয়টি হাসপাতালে ৯২৮টি সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে ৫২৮টিতে।

রোগতত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের শতভাগ মানুষ মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধিসমূহ মেনে না চললে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা দুরূহ হয়ে পড়বে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান গত কয়েকদিন আগে করোনার সংক্রমণ আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, করোনার সংক্রমণ এখনো প্রতিরোধ করা না গেলে হাসপাতাল গুলোতে রোগীর চাপ সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের চার্জ বেশি হওয়ায় সাধারণ রোগীরা সেখানে যেতে পারেনা। তাদের ভরসা করতে হয় সরকারি হাসপাতালগুলোর ওপর। তারপরও বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে বর্তমানে বেড পাওয়া দুরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  অতিরিক্ত টাকা কিংবা নেতা মন্ত্রীর ফোন লাগছে।

জানা যায়, অভিজাত স্কয়ার হাসপাতালে শুধু আইসিইউতে সিট ভাড়া প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা। বাকি খরচ নির্ভর করে রোগীর অবস্থার ওপর। সে ক্ষেত্রে খরচ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকে। রোগীর প্রয়োজন ভেদে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ওপর নির্ভর করে খরচের হার।

রাজধানীর আরেক অভিজাত ইউনাইটেড হাসপাতালে আইসিইউ ভাড়া প্রতিদিন ৯ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয় রোগীর চিকিৎসা খরচ, চিকিৎসক-নার্স, ওষুধসহ আরো অনেক কিছু। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন খরচ পড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। রোগীর লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন হলে এ খরচ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

মাঝারি মানের শমরিতা হাসপাতালে আইসিইউতে প্রতিদিন বেড ভাড়া ১২ হাজার টাকা। চিকিৎসক ফিসহ অন্যান্য খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। মাঝারি মানের সেন্ট্রাল হাসপাতালে আইসিইউতে প্রতিদিন ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই হাসপাতালে আইসিইউ দুই ধরনের। একই রুমের ভেতরে দুই ভাগে রাখা হয় রোগীদের। যাদের অবস্থা বেশি সংকটাপন্ন তাদের রাখা হয় সাড়ে ছয় হাজার টাকার বেডে।

অপরদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নিউরোসায়েন্স অব ইনস্টিটিউট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মিটফোর্ড  হাসপাতাল সরকারি বলে সেখানে আইসিইউতে কোনো খরচ হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে খরচ তুলনামূলক কম।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!