• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ভয়াবহ বিপর্যয়


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ৫, ২০২১, ০৫:৪৭ পিএম
স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ভয়াবহ বিপর্যয়

ঢাকা : কয়েক দিন ধরে প্রতিদিনই হচ্ছে করোনা শনাক্তের নতুন রেকর্ড। মৃত্যুর সংখ্যাও প্রতিদিন অর্ধশতাধিকের বেশি। এ নিয়ে জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি হলেও সচেতন নয় কেউ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে অবহেলা আর উদাসীনতায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সাধারণ মানুষকে বাধ্য করতে পারলে এখনো পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব। তা না হলে নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়।

রোববার (৪ এপ্রিল) করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৮৭ জন। সোমবার (৫ এপ্রিল) এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৭৫ জনে। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এটাই এক দিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্তের রেকর্ড। প্রতিদিনই পুরনো রেকর্ড ভেঙে হচ্ছে নতুন রেকর্ড। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৬২৯ জন। মার্চে তা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৯ জন।  

সার্বিক এসব পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কতটা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। তাই এবারের ভয়াবহতাকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তুলনা করছেন ‘সুনামি’র সাথে। পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য খাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার। করোনা টেস্টের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন কঠোরভাবে পালনের এবং স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি অনুসরণের। নাহলে পরিস্থিতি খুব দ্রুত নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদিও লকডাউন বা সবকিছু বন্ধ করে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখা আমাদের মতো দেশের পক্ষে সম্ভব না। আবার স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে না পারলে ভয়াবহ যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে তা সামাল দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই আমাদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার প্রথম ধাক্কার চেয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘সুনামি’র সাথে তুলনা করা যায়। যে হারে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বলা যায় পরিস্থিতি খুব দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে। জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। যে ভাবেই হোক আমাদের মাস্ক পরিধানসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার করোনা সংক্রমণ রোধে যে ১৮টি নির্দেশনা দিয়েছে তা করোনা প্রতিরোধের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত। সেখানে চিকিৎসার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এখন সেই নীতিগত বিষয়ে কার্যপ্রণালি ঠিক করতে হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে একসাথে কাজ করতে হবে।

তার মতে, লকডাউন আমাদের দেশে সম্ভব না। সেই অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের নেই। আমাদের উচিত খুব দ্রুত করোনা রোগী শনাক্ত করে তাদের আইসোলেশন করা।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গতবার প্রধানমন্ত্রী দেশের সব জেলা হাসপাতালে আইসিইউ চালু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর মাত্র ২৮টি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ চালু হলেও বাকি ৩৬ জেলায় চালু হয়নি। এটা হতাশাব্যঞ্জক বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. বিলকিস বেগম জানিয়েছেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

গতবারের করোনা চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর মধ্যে পরবর্তীতে যেগুলো নন-ডেডিকেটেড করা হয়েছিল সেগুলোর অনেকগুলোকেই আবার ডেডিকেটেড করা হচ্ছে। ডাক্তার-নার্সসহ সবাইকে প্রস্তুত রাখাসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ ক্ষেত্রে সজাগ আছেন বলে জানান তিনি।

করোনাভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণরোধে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া নির্দেশনাগুলো যথাযথভাবে পালন করা এবং সেসব বিধিনিষেধ পালনে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা পালনের কথা বলেছেন তারা।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাস ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার জনগণকে কিছু গাইডলাইন দিয়েছে। এখন জনগণকে সেই জায়গায় সাড়া দিতে হবে। জনগণ যদি গাইডলাইন মেনে না চলে তাহলে পুরো পরিস্থিতি বাইরে চলে যাবে। নিয়ম মানতে বাধ্য করতে প্রয়োজনে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে জরুরি অবস্থা জারির পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, জনসচেতনতার আগে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সচেতন হতে হবে। বাসে যাত্রী অর্ধেক করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। যে ৩১টি জেলায় করোনা বেশি ছড়িয়েছে সেসব জেলাকে রেড জোন ঘোষণা করা উচিত এখনই। সংক্রমণ রোধে মানুষের চলাচল সীমিত করতে হবে। টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

আক্রান্তদের কঠোরভাবে আইসোলেশনে রাখতে হবে এবং সেটা বাসায় নয়, করতে হবে হাসপাতালে। সেই সাথে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যারা আসবে তাদেরও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে এবং নিয়মিত তাদের পরীক্ষা করতে হবে। এভাবে করতে পারলে প্রথম ২৮ দিনে সংক্রমণ প্রথমে অর্ধেক এবং পরে ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে।

করোনা সংক্রমণরোধে সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। সেই সাথে সাধারণ মানুষকেও সরকারের দেওয়া নির্দেশনাগুলো পালনে বাধ্য করতে হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করেন, মাস্কের ব্যবহার ছেড়ে দেওয়া ছাড়াও বিগত মাসগুলোতে বিয়েসহ প্রচুর সামাজিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সভা সেমিনার, পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া ভিড়, যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া নতুন ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে শনাক্তের হার বেড়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল এ প্রসঙ্গে বলেন, যেকোনো জায়গায়ই মানুষের সমাগম হলে সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব হয় না, এটা অনেক বড় একটি কারণ। ডিসেম্বরে আমাদের এখানে যখন করোনা পজিটিভের হার কমতে শুরু করেছে তখন মানুষ মাস্ক ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে। আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমাদের এখনো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এই ভুলে যাওয়ার খেসারতই এখন দিচ্ছি আমরা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!