• ঢাকা
  • বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় দিশেহারা শ্রমজীবী মানুষ


বিশেষ প্রতিনিধি     এপ্রিল ১১, ২০২১, ০৩:২১ পিএম
করোনায় দিশেহারা শ্রমজীবী মানুষ

ঢাকা : রাজধানীর মধুবাগ ও হাজীপাড়া এলাকার একাধিক গলিতে প্রতিদিন শতাধিক দিনমজুরের হাট বসে। যার দিনমজুর দরকার, তিনি এখানে এসে দিনমজুর ভাড়া করে নিয়ে যান। দিনমজুররাও গড়ে দৈনিক ২৫০-৩৫০ টাকা চুক্তিতে কাজ পেয়ে যান। 

কিন্তু বর্তমান সময়ে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। শ্রম বিক্রির জন্য দিনমজুররা বসে অপেক্ষা করলেও ক্রেতার দেখা নেই। কাজ জোটে হাতে গোনা কয়েকজনের। বাকিদের ফিরে যেতে হয়েছে কাজ না পেয়ে।

এ চিত্র আজিমপুর, মগবাজার, কারওয়ানবাজার, বাড্ডা, উত্তরা, রামপুরা, খিলগাঁও, তেজগাঁও বেগুনবাড়িসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গার। কর্মহীনদের কপালে এখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ। দিনমজুরদের জমানো অর্থ নেই বললেই চলে। ফলে পরিবারের মুখে কী তুলে দেবেন সেই দুশ্চিন্তা তাদের তাড়া করে ফিরছে। লকডাউনে কাজ না থাকায় এই শ্রেণি-পেশার মানুষের দুঃখ এখন অবর্ণনীয়। লকডাউন তাদের কাছে এক প্রকার অভিশাপ। রামপুরার আব্দুল জব্বার বলেন, লকডাউন এলে আমাদের হাহাকার আসে। কোনো কাজেই কেউ নেয় না। কাজ দেওয়ার লোকও আসে না।

তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিন কাজ করি। দিন শেষে কাজের টাকা দিয়ে চাল ডাল কিনি। কিন্তু গত কয়েক দিনে মাত্র এক দিন কাজ এসেছে। শুনছি সামনে আবার লকডাউন আসবে। আমরা কী করে চলব। সাইফুল ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, গতবার লকডাউনে একবার সাহায্য পেয়েছিলাম। তাতে কিছুদিন যায়। পরের দিনগুলো খুব কষ্টে কেটেছে। বর্তমান সময়ে আমাদের ভালোই কাজ হচ্ছিল। 

কিন্তু হঠাৎ করেই আমরা আবার কষ্টে পড়ে গেছি। এখন আর কেউ কাজে নেওয়ার জন্য আসে না। কাজে নেওয়ার লোকের অপেক্ষায় আমরা বসে থাকি। কিন্তু লোকও আসে না, আমাদের কেউ কাজেও নেয় না।

একই দশা রাজধানীর বেইলি রোডে কাজ করা বিউটি পারলার কর্মী পুষ্পিতার। দিনের আয় থেকে মালিককে কমিশন দেওয়ার পর যা থাকে, তা দিয়েই চালান চার সদস্যের সংসার। লকডাউনে অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি বন্ধ হয়ে গেছে বিউটি পারলার।

দুধ বিক্রেতা আব্দুস সালাম বলেন, তিনি বাসায় মাস ভিত্তিতে দুধ বিক্রি করেন, এখন অনেকেই আর দুধ নেন না, বিক্রি অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। তিনি বলেন, কেউ কেউ বাসায়ই যাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।

কমে গেছে চা দোকানি জামাল হোসেনের বিক্রিও। সন্ধ্যার আগেই তাই দোকান বন্ধ করে দেন তিনি তার আশঙ্কা, ‘আর কয়েক দিন পর মনে হয় দোকান বন্ধই করে দিতে হবে। কিছু জমানো টাকা আছে তা দিয়ে আর কয়দিন চলবে?’

করোনা প্রকোপ দমাতে গত বছর ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। টানা ৬৬ দিন চলে এই সাধারণ ছুটির ব্যানারে অঘোষিত লকডাউন। তখনো মানুষ কাজ হারিয়েছে, আয় হারিয়েছে। এ কারণে সার্বিক দারিদ্র্য বেড়ে গেছে বলে বিভিন্ন গবেষণা জরিপে উঠে এসেছে।

‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব’ শিরোনামে সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোরামের (সানেম) এক জরিপে উল্লেখ করা হয়, করোনায় দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ছিল ২১.৬ শতাংশ। 

এ ছাড়া শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালে ছিল ১৬.৩ শতাংশ, যা করোনাকালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৪ শতাংশ। 

জরিপে বলা হয়, করোনা মহামারীর প্রভাবে চরম দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে কয়েক শতাংশ। সানেমের জরিপ অনুসারে ২০১৮ সালে এটি ছিল ৯.৪ শতাংশ। আর ২০২০ সালে মহামারীর প্রভাবে তা বেড়ে হয়েছে ২৮.৫ শতাংশ।

গত বছর লকডাউনে পড়া ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ওই সময় অনেকেই পরিস্থিতি সামলাতে আগের জমানো টাকা খরচ করেছেন। অনেকে আবার চলেছেন ঋণ করে। সেই পর্যুদস্ত দশা কাটার আগেই এবার দ্বিতীয় দফা লকডাউন। অনেকেরই নুন আনতে পানতা ফুরানোর সময় যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, করোনা থেকে রক্ষা পেতে হলে ঘরের বাইরে বের হওয়া যেমন উচিত নয়, তেমনই জীবন বাঁচাতে জীবিকা ধরে রাখাও জরুরি। সরকারকে তাই জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। 

এ ক্ষেত্রে দরিদ্র, ছিন্নমূল, দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তার জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে নগদ আর্থিক সহায়তারও পদক্ষেপ থাকা জরুরি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!