• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বেড়েই চলেছে বেকারের সংখ্যা


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১১, ২০২১, ০৩:২৮ পিএম
বেড়েই চলেছে বেকারের সংখ্যা

ঢাকা : মিরপুরের মণিপুরীপাড়া এলাকার বাসিন্দা স্বপ্না খান। স্বামী জটিল রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত হয় গোটা পরিবার। বিপাকে পড়ে সামান্য পুঁজিতে একটি ফাস্টফুডের দোকান দিয়ে শুরু হয় তার এই নগরীতে দুই সন্তান নিয়ে টিকে থাকার লড়াই। 

দিশেহারা স্বপ্নার কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য মানসিকতায় একসময় সফলতা ধরা দেয়। খাবারের ব্যবসার পাশাপাশি শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। দীর্ঘ ২১ বছরে একে একে তিনটি শোরুম করেন স্বপ্না। তার অধীনে কর্মসংস্থান হয় ৮ জনের।

কিন্তু গত বছর শুরু হওয়া করোনা মহামারী তার ২১ বছরের সব অর্জন কেড়ে নিয়েছে। মহামারীতে প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকে শোরুমগুলো। কিন্তু দোকান মালিককে ভাড়া দিতে হয় নিয়মিত। কর্মচারীদের বেতনও। এরপর শোরুম চালু করলেও বেচাবিক্রির অভাবে কর্মচারীদের বেতন আর দোকান ভাড়ার চাপে বন্ধ করতে হয়েছে। দোকানের মালামাল অনলাইনে বিক্রির চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেখানে তীব্র প্রতিযোগিতার সাথে টিকে থাকতে না পেরে এখন স্বপ্নার চোখে কেবলই দুঃস্বপ্ন। 

তিনি জানান, ‘করোনা তাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। প্রায় ৫০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’

এখন সন্তানদের পড়ালেখা, বাসা ভাড়া আর ভরণ-পোষণ জোগাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে তাকে। করোনা শুধু তাকেই সর্বস্বান্ত করেনি, বেকার হয়েছেন তার ৮ কর্মচারীও। করোনার থাবা এমনিভাবেই স্বপ্না খানের মতো অসংখ্য মানুষকে পথে বসিয়েছে। কেউবা ব্যবসার পুঁজি হারিয়ে আবার কেউ চাকরি হারিয়ে।

গতবছর লকডাউনে চাকরি হারিয়েছেন বিভিন্ন পেশার লাখো মানুষ। যাদের অনেকেই এখনো পেশায় ফিরতে পারেননি। উপায়ান্তর না দেখে যারা গ্রামে চলে গেছেন, তারা আবারো ফিরেছেন রাজধানীতে কর্মসংস্থানের আশায়। 

কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ছাঁটাই করা লোকবল আর পুনঃনিয়োগ করেনি। তাদেরই একজন মোহাম্মদ কামাল হোসাইন। একটি অনলাইন পত্রিকায় কর্মরত থাকা অবস্থায় গেল বছর জুনে চাকরি হারান। কর্তৃপক্ষের থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় চাকরিতে বহাল করা হবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে এখনো বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দিশেহারা জীবন যাপন করছেন তিনি।

গত ২৯ জানুয়ারি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে, যা ছিল ২০১০ সালে ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ।

তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুসারে করোনাভাইরাসের প্রভাবে ২৫ শতাংশে পৌঁছতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এলোমেলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গেল কয়েক মাসে কর্মহীন, চাকরি হারানো বা বিদেশফেরত লোকের সংখ্যা আরো বেড়েছে। নতুন নিয়োগ বা কাজের জোগান বর্তমান অবস্থায় খুবই সীমিত। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে চাকরির বাজার পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পালটে গেছে। 

অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা না হওয়ার কারণে কর্মী ছাঁটাই করছে, আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই না করলেও নতুন নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটের কারণে বাংলাদেশে প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (২৭.৩৯%)।

ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই বেকারত্ব আরো বেড়েছে। বেকারত্বের হারের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। সরকারি চাকরিতে শূন্য পদের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮। করোনার কারণে গত ৬ মাস ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সব ধরনের নিয়োগ স্থগিত থাকায় এ সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। এসব পদে নিয়োগ পেতে অপেক্ষায় আছেন ২০ লাখের বেশি শিক্ষিত বেকার।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিগ্রি আছে এমন বেকারের সংখ্যা ৪ লাখ। করোনার প্রভাবে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে চাকরি হারিয়েছেন অনেকেই। দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে চাকরির জন্য লড়াই করতে হয় লাখ লাখ তরুণকে। অনেক শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয়। 

এর মধ্যে প্রতি বছর বিসিএস পরীক্ষার জন্য অপেক্ষায় থাকেন হাজার হাজার তরুণ। নন-ক্যাডার সরকারি ও বেসরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেন আরো বেশিসংখ্যক পরীক্ষার্থী। করোনা পরিস্থিতির কারণে সব চাকরির পরীক্ষাই আটকে গেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে চাকরির পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও শেষ পর্যায় পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। 

অনেকেই আছেন, যাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বেশিদিন নেই। স্বভাবতই তারাই বেশি উদ্বিগ্ন। বস্তুত করোনা যুব সম্প্রদায়ের হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক।

এদিকে, বেকারত্ব দূর করতে সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তার সফল বাস্তবায়ন নিয়েও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে করোনা পরিস্থিতির কারণে। 

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম জানান, অষ্টম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনায় ১ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ লাখ ৫ হাজারের কর্মসংস্থান হবে বিদেশে। 

এই সময়ে দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ দশমিক ০১ মিলিয়ন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ দশমিক ১৩ মিলিয়ন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ২৬ মিলিয়ন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ দশমিক ৪১ মিলিয়ন ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ দশমিক ৫২ মিলিয়ন মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে সরকার।

কিন্তু সরকারের এই লক্ষ্যকে উচ্চাভিলাসী বলছেন, অর্থনীতিবিদরা। কারণ, এর আগে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থানের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তার চেয়ে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান কম হয়েছে। 

এ কারণে, সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তুলনায় ১০ লাখ কম নির্ধারণ করেছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অনেক লক্ষ্যই পূরণ হয়নি। ফলে সেগুলোর অনেক কিছু অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ঠাঁই পেয়েছে। 

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় গত পাঁচ বছরে (২০১৬-২০) মোট কর্মসংস্থানের লক্ষ্য ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ। এর মধ্যে দেশীয় ১ কোটি ৯ লাখ ও বিদেশি ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃজনের লক্ষ্য থাকলেও কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪ লাখ কম (৯৫ লাখ)। এর মধ্যে দেশে ৬০ লাখ ও প্রবাসে ৩৫ লাখ।

জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম বিবিএসের রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে জানান, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিবছর গড়ে ১৮ থেকে ১৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। এবার প্রয়োজন অনুযায়ী সবার কর্মসংস্থানে কোনো সমস্যা হবে না বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!