• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভোগান্তি বেড়েছে রোগীদের


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ৩০, ২০২১, ০৪:৫৪ পিএম
ভোগান্তি বেড়েছে রোগীদের

ঢাকা : মুমূর্ষু রোগী নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরছেন স্বজনরা। কোথাও ঠাঁই নেই। তাই মিলছে না চিকিৎসা। কারণ করোনা রোগীর চাপে বেসামাল রাজধানীর সব হাসপাতাল। এ কারণে শ্বাসকষ্টসহ গুরুতর সাধারণ রোগীদের আইসিইউ দরকার হলেও মিলছে না। এমনকি মুমূর্ষু রোগীও ভর্তি হতে পারছেন না হাসপাতালে। কোনো হাসপাতালের ছাড়পত্র থাকলেই কেবল নতুন রোগী ভর্তি নেওয়া হয়। তবে এই সংখ্যাটা খুবই কম। করোনা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে হাসপাতালে রোগী ভর্তির চাপ সামলানো কঠিন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া জনবল সংকটসহ পরীক্ষার জন্য ল্যাবে যন্ত্র বিকল হওয়ায় চিকিৎসা নিতে ভোগান্তির শেষ নেই সাধারণ রোগীদের। আর অবস্থা একটু জটিল হলেই উপজেলা বা জেলা হাসপাতালগুলো থেকে রোগীদের ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। অথচ ঢাকায় এসে এসব রোগী হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারছেন না। অন্যদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্বাভাবিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন।

টিউমারের অপারেশন করতে নরসিংদী থেকে ঢাকায় এসেছেন খুরশিদা বেগম। ঢাকা মেডিকেলে জরুরি বিভাগের মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। দিনভর চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করেও ছেলে তার মুমূর্ষু মাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি।

কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসা গুরুতর অসুস্থ তাসলিমা বেগমের অক্সিজেন দরকার। শ্বাসকষ্ট নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে রাজধানীর একাধিক হাসপাতাল ঘুরে মুগদা হাসপাতালে এসেছে। এখানে ভর্তি হলেও মেলেনি শয্যা, ব্যবস্থা হয়নি অক্সিজেনের।

চাঁদপুরের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সি মোবারক মিয়ার বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট বেড়েছে ২-৩ দিন ধরে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়াতে তাকে নেওয়া হয় চাঁদপুরের সরকারি হাসপাতালে। অক্সিজেন লেভেল একটু কম থাকায় সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ঢাকার মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। কিন্তু মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পজিটিভ সার্টিফিকেট না থাকাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপতালের (ঢামেক) পরামর্শ দেন। ঢামেক থেকেও জানানো হয় কোনো সিট খালি নেই। তারা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন।

মোবারক মিয়ার ভাতিজা জুবায়ের আহমদ বলেন, পরিচিতজনদের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়েছি। কোনো হাসপাতালেই রোগী ভর্তির সুযোগ নেই। একমাত্র ভরসা বেসরকারি হাসপাতাল। আমাদের টাকার জোরও কম। বেসরকারিতে ভর্তি করতে অনেক টাকা দরকার। চাঁদপুর থেকে ঢাকায় পাঠিয়ে আমাদের কোনো লাভ হয়নি বরং এখন পর্যন্ত তিনটি অ্যাম্বুলেন্স পরিবর্তন করেছি। প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো ভাড়া দিয়েছি।

করোনা মহামারীতে এমন চিত্র এখন রাজধানীর সব সরকারি হাসপাতালে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গুরুতর রোগীরা এলেও চিকিৎসা পেতে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। সরকারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ের অধুনিক সুবিধা থাকলেও রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন অনেকে। অন্যদিকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েও। বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে গুরুতর ও মুমূর্ষু রোগীদের করোনা পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি নিচ্ছে না। এক হাসপাতালের করোনা পরীক্ষা কাজে লাগছে না অন্য হাসপাতালে। আবারো পরীক্ষার ভোগান্তিতে রোগী আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে জাতীয় হূদরোগ হাসপাতালে রোগীদের ইকোকার্ডিওগ্রাফি পরীক্ষা করা হচ্ছে না। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে হূদরোগীদের এই বিশেষ পরীক্ষাটি বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে রোগীদের হাসপাতালের বাইরে গিয়ে ইকো করিয়ে আনতে হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন বেড়েছে ব্যয়, অন্যদিকে ভোগান্তি।

করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে হাসপাতালের এক শ্রেণির চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ইকো করা বন্ধ রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যেখানে হূদরোগ হাসপাতালে সাদা-কালো ইকো ফি ২০০ টাকা, কালার ইকো ফি ৬০০ টাকা, সেখানে হাসপাতালের সামনের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক থেকে দ্বিগুণ, তিনগুণ ফিস দিয়ে ইকো করিয়ে আনতে হচ্ছে।

প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ রোগীর ইকো করাতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিভাগের এক কর্মচারী বলেন, অন্যান্য হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপের কারণে তারা অন্য রোগীর টেস্ট নিচ্ছে না। তাই এখানে প্রতিদিন প্রচুর রোগী আসে এবং তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ইকো করার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসকরা যান্ত্রিক সমস্যা দেখিয়ে ইকো করছেন না। ফলে রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, মূলত ইকো করার জন্য রোগীদের কাছে কোভিড সনদ চাওয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ হূদরোগীর কোভিড পরীক্ষা করা থাকে না। ফলে চিকিৎসকরা ইকো করছেন না। আরেকটি কারণ হলো, একটি ইকো করতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। তাই হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তাররা ইকো করতে চান না। তাদের দেখাদেখি জুনিয়র ডাক্তাররাও ইকো করতে অনীহা প্রকাশ করছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, ইকো হচ্ছে না কথাটি ঠিক না। আমাদের হাসপাতালে দুইশ শয্যার কোভিড ইউনিট চালু করা হয়েছে। অনেক চিকিৎসক সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। এ জন্য হয়তো ইকো কম হতে পারে। তবে বন্ধ করা হয়নি।

ভোগান্তির শেষ নেই জটিল রোগীর পরীক্ষা করাতে গিয়েও। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একজন করোনা আক্রান্ত রোগী তার সিটিস্ক্যান রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন পাঁচ দিনেরও বেশি সময় ধরে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই রোগীর সন্তান বলেন, তিন দিন আগে আমার মা এখানে ভর্তি হন। সেদিনই তার সিটিস্ক্যান করা হয়। তখন থেকে আমরা রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।

চিকিৎসকরা বলেছেন, পরীক্ষা করানোর পাঁচ দিন পর পাওয়া যাবে রিপোর্ট। অর্থাৎ এই পাঁচ দিনে রোগীর শারীরিক অবস্থা বুঝতে পারছেন না চিকিৎসকরা। রিপোর্ট না পেলে পরবর্তী চিকিৎসা কী হতে পারে সে সিদ্ধান্তও নেওয়া যাচ্ছে না।

সিটিস্ক্যান রিপোর্ট দেওয়ার জন্য রেডিওলোজি বিভাগের কেন পাঁচ দিন লাগছে জানতে চাইলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. নুরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে বিভাগটিতে তিনজন অধ্যাপক ও চার থেকে পাঁচজন মেডিকেল অফিসার আছেন। করোনা পরিস্থিতিতে পালা করে কাজ করার জন্য একটি ডিউটি রোস্টার তৈরি করা হয়েছে।

আমরা একটি ডিউটি রোস্টার তৈরি করেছি যাতে এটা নিশ্চিত করা যায় যে অন্তত অর্ধেক কর্মী সবসময় ডিউটিতে থাকবেন এবং বাকিরা যেন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পারেন। বর্তমানে দুজন ডিউটিতে আছেন। তাদের মধ্যে একজন রেডিওলোজিস্ট, অপরজন মেডিকেল অফিসার।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. আব্দুল মালিক বলেন, হঠাৎ করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। এতে অনেক সাধারণ রোগীও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর রোগীর স্বজনরা আরো আতঙ্কিত হয়ে তাকে নিয়ে হাসপতালে ভিড় জমাচ্ছে। এভাবেই হাসপতালগুলোকে সক্ষমতার কয়েকগুণ চাপ নিতে হয়। তাই করোনা নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার বে-নজীর আহমেদ বলেন, চলমান হিসাবে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। করোনা আক্রান্ত নয় এমন রোগী এখন আতঙ্ক নিয়ে হাসপতালে ভিড় জমাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আগে করোনা নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!