• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশে কর্মহীনের সংখ্যা বাড়ছে


বিশেষ প্রতিনিধি মে ২, ২০২১, ১২:১০ এএম
দেশে কর্মহীনের সংখ্যা বাড়ছে

ঢাকা : করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ব। বন্ধ হয়ে গেছে অসংখ্য শিল্পকারখানা।  কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা। সেই সাথে বাড়ছে কর্মহীন শ্রমিকের সংখ্যা। এতে অসহায় হয়ে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। খাবারের জন্য লকডাউন উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হয়েও মিলছে না কোনো কাজ। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন খাতের সোয়া পাঁচ কোটি শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা রয়েছে হুমকির মুখে।

বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদদের মতে, করোনার প্রভাব দীর্ঘ হওয়ায় গরিবরা আরো গরিব হচ্ছে। আর বেকাররা নতুন করে কাজে ফিরতে পারছেন না। এই করোনাভাইরাসের মধ্যেই গত বছরও ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে মে দিবস পালিত হয়, এবারও হচ্ছে। যদিও মে দিবস এলেই শ্রমিকের দৃঢ়প্রত্যয়ী সুঠাম শরীরের দৃশ্যপটই ভেসে ওঠে সাধারণ মানুষের মনে।

কিন্তু এবার শ্রমিকের মলিন মুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কার প্রতিচ্ছবিই প্রতিফলিত হচ্ছে। কারণ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে সরকারি নির্দেশে সারা দেশে ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন চলছে। সাধারণ ছুটির মধ্যে কিছু কলকারখানা চললেও জরুরি সেবা ছাড়া বন্ধ রয়েছে গণপরিবহনসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান। শ্রমজীবী মানুষরা এখন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে কাজে যেতে পারছেন না।

সরকারের নির্দেশিত কঠোর নিষেধাজ্ঞা মানতে গিয়ে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত হতদরিদ্র, দরিদ্র, দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, নৌ ও গণপরিবহন শ্রমিক, রিকশাচালক, ভ্যানচালকসহ লাখো শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এতে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব মানুষ এখন বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছেন প্রতিদিন। সুদিন ফেরার আশায় দিন গুনছেন তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৭) অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বড় অংশ ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। তারাই দিন আনে দিন খায়। দেশের মোট ৬ কোটি ৮ লাখ লোক মজুরির বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজে আছেন। এর মধ্যে ৫ কোটির বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। যেখানে কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেকটা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন তারা। অন্যরা আনুষ্ঠানিক খাতের। করোনায় তাদের জীবিকাও হুমকিতে আছে।

দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমজীবী লোকের মধ্যে কৃষি খাতে আছেন ২ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার নারী-পুরুষ। শিল্প খাতে ১ কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ কাজ করেন। আর সেবা খাতে আছেন প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ।

যাদের শ্রম আইন-২০০৬ প্রদত্ত নিয়োগপত্র, কর্মঘণ্টা, ঝুঁকিভাতা, চিকিৎসাভাতা, বাড়িভাড়াসহ বেশির ভাগ অধিকারই নিশ্চিত নয়। কাজের ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা। করোনাভাইরাস ওসব মানুষের জীবিকায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। গত বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর আগে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। তবে করোনা শুরুর কিছুদিনের মধ্যে ওই সংখ্যা ৪২ শতাংশে গিয়ে ঠেকে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।

সংস্থাটির জরিপ অনুযায়ী ৪২ শতাংশ মানুষ এখন দরিদ্র। অর্থাৎ শুধু করোনার কারণেই বাংলাদেশ প্রায় ২০ বছর আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। এরই মধ্যে এসেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও শ্রমবিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের দেড় কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। আর লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে তারা চরম খাদ্য সংকটে পড়বে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, করোনা প্রাদুর্ভাবে গতবারের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে দেশে খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রেণির মানুষজনই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি প্রবাসী আয়। করোনার প্রথম ধাক্কায় প্রবাসী আয় না কমলেও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক যাওয়া ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ফলে মাসওয়ারি ভিত্তিতে প্রবাসী আয় কমতে শুরু করেছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় পরিস্থিতি আরো বেগতিক হতে পারে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনা মহামারীর প্রভাবে প্রায় দেড় কোটি লোক নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের এক গবেষণায় বলা হয়, করোনা মহামারীতে ১ কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। তার গবেষণায় দেখানো হয় দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিল। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছে ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সেবা খাতে বেকার হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এক পর্যবেক্ষণে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, চলমান করোনায় নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়বে প্রায় চার কোটি মানুষ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ সমীক্ষায় করোনার প্রভাবে নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে বলে তথ্য উঠে এসেছে। কোভিডের আঘাত সব জায়গায় একইভাবে অনুভূতি হয়নি। শহরের তুলনায় গ্রামে প্রভাব কমই দেখা গেছে। যে কারণে শহরের বস্তিবাসীর জীবন গ্রামের শ্রমজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি অরক্ষিত।

তাছাড়া ভাড়া বাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। আশ্চর্যজনকভাবে সবার সঞ্চয় কমেছে। অরক্ষিত অদরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ কোভিড-পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে সব শ্রেণিতেই ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের হার সামগ্রিকভাবে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিবিএসের  জরিপ সূত্র জানায়, করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। ওসব খাতেই দেশের ৩৫ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় ওই খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রথম ধাক্কায় অনেকেই লোকসানে পড়েছে। এখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কায় তারা আর দাঁড়াতে পারছে না।

এরই মধ্যে আরো বড় আকারে ধাক্কা দিয়েছে করোনার প্রভাব। করোনায় কৃষি খাতে কাজ হারিয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ মানুষ। তার মধ্যে প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ পুনরায় কাজে ফিরতে পারেনি। শিল্প খাতে প্রায় ৯৩ লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তার ৩৭ লাখ শ্রমিকের তাদের কাজ হারানোর শিল্পে ফেরার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি সেবা খাতে ১ কোটি ৫৩ লাখ কর্মী চাকরি হারিয়েছে। এদের মধ্যে ৬১ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। নতুন করে আগের কাজে ফিরতে পারেনি। কাজে ফিরতে না পারা ওসব মানুষ দরিদ্রতার শিকার হচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের হিসাবে সারা দেশে পরিবহন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। কঠোর লকডাউনে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ। ফলে এরই মধ্যে কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছে ওই খাতের কয়েক লাখ কর্মী।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছে, এ খাতের শ্রমিকরা সবাই দিনভিত্তিক মজুরি পায়। লকডাউনের কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়েছেন তারা।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) মুখ্য আইন উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, করোনাকালীন দুর্যোগ মোকাবিলায় শ্রমজীবী মানুষের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব মানুষ বিপদে পড়লে কীভাবে তাদের সহযোগিতা করতে হয়, সেটা সবাইকে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস্) বিলসের সহসভাপতি শিরীন আখতার বলেন, চলমান করোনায় নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়বে প্রায় চার কোটি মানুষ। তৈরি পোশাক, রেস্তোরাঁ ও শিল্পকারখানা চালু রাখার সুযোগ থাকলেও নির্মাণ, পরিবহন, পোলট্রিসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত অসংখ্য মানুষের জীবিকা পড়ছে সংকটে। তাই বিত্তবানদের শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ঠিকমতো সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না, তা তদারক করতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেন, করোনার কারণে কাজ হারানো মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশ সামনে কোনো কাজ ফিরে পাবে না। তা ছাড়া করোনার প্রভাবে আগামীতে কর্মসংস্থানের প্যাটার্নও পাল্টে যাবে। যেখানে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানের গুরুত্ব বাড়বে। সে জন্য এসব শ্রমজীবী মানুষদের জন্য নতুন করে কর্মসংস্থান করতে হবে। এর প্রধান ভূমিকা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

 

Wordbridge School
Link copied!