• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
সেবাগ্রহীতারা ঘরে বসে কাজ সারতে পারবেন

ভূমি ডিজিটালে ধীরগতি


বিশেষ প্রতিনিধি মে ৩, ২০২১, ০২:০২ পিএম
ভূমি ডিজিটালে ধীরগতি

ঢাকা : একযুগেও শেষ হয়নি ভূমি ব্যবস্থাপনার ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া। সেবাগ্রহীতা ভূমিসংক্রান্ত সব কাজই ঘরে বসেই করতে পারবেন এমন পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয় ভূমি ডিজিটালাইজেশন প্রকল্পের কাজ। কিন্তু শুরু থেকেই প্রকল্পের কাজ চলছে ধীরগতিতে। প্রথম দফায় প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও মূল প্রকল্পের কাজ হয়েছে এক-তৃতীয়াংশেরও কম।     

২০১৯ সালের মধ্যে ভূমি সেবা খাতের দুর্নীতি রোধ করতে সরকার ২০১০ সালে পুরো ভূমি ব্যবস্থাপনাকেই ডিজিটালের (অটোমোশন) আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) অফিসগুলোর এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনিচ্ছায় পুরো ডিজিটালাইজেশনকরণ প্রক্রিয়াই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তেমন এগোয়নি। নতুন অনুমোদিত জুন ২০২৫ পর্যন্ত বর্ধিত সময় দিয়ে এখন চলছে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ।

তবে বিগত একযুগে প্রকল্পের আওতায় দেশের তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১টি জেলার সিএস, এসএ, আরএস ও দিয়ারা জরিপের মোট ৪ কোটিরও বেশি খতিয়ান অনলাইনে আপলোড করা হয়েছে। আরো বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পুরো প্রকল্প ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় আনা গেলে কমে যাবে ভূমি অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য। সেবাগ্রহীতারা জমির নিবন্ধন, নামজারি, খাজনাসহ সব কাজই ঘরে বসে করতে পারবেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ভূমি খাত সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি যথেষ্টই বিদ্যমান। বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ ও স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। ডিজিটালাইজেশনের অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত সুশাসন এখনো আসেনি।

টিআইবি’র গবেষণায় উঠে এসেছে, ভূমি ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে মামলা পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রতা

তৈরি হচ্ছে। বাড়ছে ভূমিসংক্রান্ত মামলার জট। ভূমি রেজিস্ট্রেশন, নামজারি ও করের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। ভূমিসংক্রান্ত প্রতিটি সেবা পাওয়ার জন্যই নির্ধারিত-অনির্ধারিত অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ে মামলা না করতে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগের মতো ঘটনা ঘটছে। বিধিমালা না মেনে ভূমি মালিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করা হচ্ছে। ভূমি জরিপের সময় জরিপকর্মী কর্তৃক জমির পরিমাণ কম দেখানো ও খতিয়ানে ভুল তথ্য সন্নিবেশের ভয় দেখিয়ে ঘুষ আদায় করা হচ্ছে।

অন্যদিকে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ভূমি বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটাল করা সম্ভব হলে সারা দেশে সম্পত্তি অধিকারে নিরাপত্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভূমি রেকর্ড-সম্পর্কিত ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। তবে পুরো ভূমি ব্যবস্থাটি ডিজিটাল করতে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে।

কিন্তু এ ব্যয়ের প্রতি ১ টাকার বিপরীতে ৬১৯ টাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুফল পাওয়া যাবে। ডিজিটালাইজেশন হলে ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিক যেমন হবে, তেমনি জাল-জালিয়াতি ও হয়রানি অনেকাংশে কমে যাবে। তা ছাড়া আধুনিক পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ ও রেকর্ড হলে এর ওপর সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং খাসজমিও চিহ্নিত হবে।

ভূমি মন্ত্রণালয় ও ভূমি রেকর্ড অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, হয়রানি, ভোগান্তি, দুর্নীতি বন্ধে ডিজিটাইজেশন কার্যক্রম শুরু করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। সবকিছুকেই নিয়ে আসা হচ্ছে অনলাইনে। এর ফলে এসিল্যান্ড, সাব-রেজিস্ট্রার, ভূমি অফিসে না গিয়েই সেবা পাওয়া যাবে ঘরে বসে। এরই মধ্যে সাভার উপজেলার ভূমি দপ্তরকে ডিজিটালাইজ করার একটি পাইলট প্রকল্প শুরু হয়েছে। রেকর্ড কাগজ থেকে সফটওয়্যারে চলে যাওয়ায় ব্যয় অনেকটাই কমে এসেছে, আর এই সেবাও জনগণের জন্য অনেক সহজ হয়ে এসেছে।

প্রকল্পের আওতায় সেসব কাজ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-দেশের সব ভূমি অফিসে আইপি ক্যামেরা স্থাপন, দলিলের কপি মন্ত্রণালয়ে জমাকরণ, ই-নামজারি, মৌজা ও প্লটভিত্তিক ভূমি জোনিং, ডিজিটাল রেকর্ডরুম থেকে খতিয়ান ও অনলাইনে খাজনার পাইলটিং ইত্যাদি।

এসিল্যান্ড অফিসে আইপি ক্যামেরা : দেশের সব এসিল্যান্ড অফিসে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ (আইপি) ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। ভূমি মন্ত্রণালয়ে বসে এসিল্যান্ড অফিসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা যাবে। অফিসের সবার কথাবার্তাও শোনা যাবে। এটি বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় মনে করছে, এটি চালু হলে দালালের দৌরাত্ম্য কমবে। কোনো রেকর্ড, নথি বের হচ্ছে কি না দেখা যাবে। কী কী কাজ করা হয়েছে, আর কী কী বকেয়া আছে সেগুলোও দেখা যাবে।

দলিলের কপি মন্ত্রণালয়ে : জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে দলিলের একটি কপি ভূমি মন্ত্রণালয়কে যাতে দেওয়া হয়, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতা (জমির মালিক) রেজিস্ট্রেশনের আবেদনের সঙ্গে অফিসে তিন কপি দলিল জমা দেবেন। এর মধ্যে এক কপি সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে থাকবে, আরেক কপি জমির মালিককে দেওয়া হবে, আরেক কপি ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসনের প্রতিনিধি এসিল্যান্ডের কাছে পাঠানো হবে। তিনি কপি পাওয়ার পর জমির নামজারির কাজ শুরু করবেন।

ই-নামজারি : ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ই-নামজারি ও মিসকেস মামলার শুনানি গ্রহণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটি হলে প্রতি বছর ২০-২২ লাখ নামজারি সহজে করা সম্ভব হবে। বছরে এক কোটিরও বেশি মানুষ এই সেবার আওতায় আসবে।

মৌজা ও প্লটভিত্তিক ভূমি জোনিং : এর মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ অনুযায়ী প্লটভিত্তিক কৃষি, আবাসন, বাণিজ্যিক, পর্যটন, শিল্প উন্নয়ন ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হবে। সারা দেশে কৃষিজমি রক্ষায় প্রকল্পটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এর আওতায় তৈরি করা হবে মৌজা ও প্লটভিত্তিক ডিজিটাল ভূমি জোনিং ম্যাপ ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা। সারাদেশে মৌজা ও প্লটভিত্তিক ডাটাবেজও তৈরি করা হবে। ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমানকে এ প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে।

ডিজিটাল রেকর্ডরুম থেকে খতিয়ান : জমির খতিয়ান সংগ্রহে হয়রানি কমাতে ডিজিটাল রেকর্ডরুম চালু করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ২১টি জেলায় এই রেকর্ডরুম চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এটি চালু করা হবে। পুরোপরি চালু হলে সেবাগ্রহীতাদের আর জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে যাতায়াত করতে হবে না। অনলাইনে খতিয়ান প্রদানের সঙ্গে খতিয়ানের অটোমেটেড সার্টিফাইড কপি প্রদানেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

৬১ জেলার খতিয়ান অনলাইনে : দেশের তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১টি জেলার সিএস, এসএ, আরএস ও দিয়ারা জরিপের মোট ৪ কোটিরও বেশি খতিয়ান অনলাইনে আপলোড করা হয়েছে। ওই ২১ জেলার পর পর্যায়ক্রমে বাকি ৪০টি জেলার রেকর্ডরুমকে ডিজিটাল রেকর্ডরুম হিসেবে চালু করা হবে।

অনলাইনে খাজনার পাইলটিং : অনলাইনভিত্তিক ভূমি উন্নয়ন কর ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে জমির খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) প্রদান করা যাবে। পাইলট কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে আটটি জেলার ৯টি উপজেলার ৯ পৌর বা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ১৯টি মৌজা নির্বাচন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এটি চালু করা হবে।

ভূমি অফিসের পাকা ভবন : প্রায় ৭৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সারাদেশের ৫০০টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও ১৩৯টি উপজেলা ভূমি অফিসের পাকা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ‘সমগ্র দেশে শহর ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশের এক হাজার শহর ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ করা হচ্ছে। চলতি বছরের জুন নাগাদ প্রকল্প দুটির কাজ সম্পন্ন হবে।

এক ছাদের নিচে সব সেবা : ভূমি মন্ত্রণালয়ের সেবাদানকারী সব দপ্তর ও সংস্থাকে একই ছাদের নিচে আনা হচ্ছে। এজন্য ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে ‘ভূমি ভবন কমপ্লেক্স’। চলতি বছরের মধ্যে ভবনটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেছে মন্ত্রণালয়। ২০ তলা ভবনটি নির্মাণে প্রায় ১০৬ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ভবনে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, ভূমি সংস্কার বোর্ড, ভূমি আপিল বোর্ডের অফিস স্থাপন করা হবে।

ভূমি ডেটা ব্যাংক : সারা দেশের সরকারি সম্পত্তি নজরদারিতে আনতে ‘ভূমি ডেটা ব্যাংক’ তৈরি করা হচ্ছে। এতে সরকারি সম্পত্তির অবৈধ ব্যবহার ও দখলদারিত্ব কমে আসবে বলে মন্ত্রণালয় মনে করছে। শতভাগ খাসজমি চিহ্নিতকরণ, অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি ও সায়রাত মহালের ডাটাবেজ তৈরি করে ভূমি তথ্য ব্যাংক তৈরি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ভূমি ডেটা ব্যাংক তৈরি করেছে। পর্যায়ক্রমে এটি সারা দেশে বাস্তবায়ন করা হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জমির নামজারি ১০ দিনে : সনদপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জমির নামজারি ১০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে পরিপত্র জারি করেছে মন্ত্রণালয়। আবেদনের তিন কার্যদিবসের মধ্যে সরেজমিন তদন্ত করে চতুর্থ কার্যদিবসে এসিল্যান্ড শুনানির নোটিশ দেবেন। এরপর ছয় কার্যদিবসের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হবে।

ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে এসিল্যান্ড, সাব-রেজিস্ট্রার ও ভূমি অফিসে মানুষের যাতায়াত কমানো। মানুষ অফিসে না গিয়ে সেবা নেবেন। ভূমির ডিজিটাইজেশনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুটি কাজ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে খাজনা ও নামজারি। মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন যখন খাজনা দিতে যান। এজন্য অনলাইনে খাজনা প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেবাগ্রহীতা ইলেকট্রনিক্যাল একটি দাখিলা পাবেন। সেটাই অফিসিয়াল দাখিলা হিসেবে গণ্য হবে।

তা ছাড়া নামজারির ক্ষেত্রে মানুষকে যাতে অফিসে যেতে না হয়, সে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জমির মালিকের শুনানি গ্রহণ করা হবে। এর জন্য শিগগির একটি সার্কুলার জারি করা হবে। পর্যায়ক্রমে সব ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশন নিশ্চিত করা হবে।

ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, ভূমিসংক্রান্ত বিষয়া কেবল সরাসরি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে না, দেশের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে। তাছাড়া দেশের সব মানুষ কোনো না কোনোভাবে ভূমির সঙ্গে জড়িত। এই খাতে উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে ডিজিটাইজেশনের বিকল্প নেই। তাই ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের পুরো কাজ ডিজিটাইজেশনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলমান।

তিনি আরো বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক মন্ত্রণালয় গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এখনো মাঠপর্যায়ে যেসব সমস্যা আছে ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটাইজেশনের পর তা থাকবে না। সিস্টেমই তখন অনিয়ম করতে দেবে না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!