• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রি-শাটডাউনে যাচ্ছে দেশ!


নিউজ ডেস্ক জুলাই ১৮, ২০২১, ০৫:০৩ পিএম
প্রি-শাটডাউনে যাচ্ছে দেশ!

ঢাকা: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে তিনটি উপায়ের কথা বলে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। টিকা, স্বাস্থ্যবিধি মানা আর নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন-এই তিন কৌশল একই সঙ্গে প্রয়োগের কথাই জোর দিয়ে বলেন দেশি-বিদেশি সব বিশেষজ্ঞরাও। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলোর সব কটিই চলছে ছন্নছাড়া অবস্থায়। না মিলছে প্রত্যাশিত পরিমাণে টিকা, মানুষ না মানছে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি আর না কার্যকর করা যাচ্ছে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। এর পরিণতিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখন দেশে বেপরোয়া।

বেপরোয়া এই সংক্রমণ ঠেকাতে পবিত্র ঈদুল আজহার পর দুই সপ্তাহের প্রি-শাটডাউনে (২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট) যাচ্ছে বাংলাদেশে। শনিবার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ঈদের পরের বিধিনিষেধ হবে কঠোর থেকে কঠোতর।

এর আগে সরকার কখনো লকডাউন, কখনো কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু কোনোটাতেই কাজ হয়নি। সাধারণ মানুষ তো বিধিনিষেধ মানছেনই না, মানছেন না দায়িত্বশীলরাও। মানুষের কাছ থেকে মানুষের মাঝে সংক্রমণ বন্ধ করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রি-শাটডাউনে (কঠোর থেকে কঠোরতর) যাচ্ছে বাংলাদেশ।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যারিয়েন্ট নয় স্বাস্থ্যবিধি অবহেলার কারণেই দেশে সংক্রমণ বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর হার। সংক্রমণের বিষয়কে আমরা যেভাবেই দেখি না কেন, বাস্তব অবস্থা এখন খুবই খারাপ। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বন্ধে মানুষকে গৃহবন্দি করে রাখার বিকল্প নেই। ঈদুল আজহা সামনে রেখে পহেলা জুলাই থেকে শুরু হয় কঠোর বিধিনিষেধ। আর শিথিল হয় ১৪ জুলাই মধ্য রাতে। এ বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত। তবে ঈদ ছুটির পরদিন থেকেই ১৪ দিনের জন্য কঠোর বিধিনিষেধের ঘোষণা দেয় সরকার। যা শুরু হবে ২৩ জুলাই সকাল ৬টায়, চলবে আগামী ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত। এ অবস্থায় লকডাউন শিথিল করায় ১৫ জুলাই থেকেই চালু হয় গণপরিবহন, খুলে দেওয়া হয় শপিংমলসহ সব ধরনের দোকানপাট।

এদিকে আগামী ২৩ জুলাই সকাল ছয়টা থেকে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত শুরু হবে কঠোর লকডাউন। এ লকডাউনে গার্মেন্টসহ সব ধরনের শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়। শেষ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা বহাল রাখায় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা ঈদের পরে শুরু হওয়া লকডাউনে শিল্প-কারখানা খোলা রাখার আহ্বান জানান।

সরকারের এ সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করে শিল্প মালিকরা বলেন, এক-দেড় বছর ধরে ক্ষতির মুখেই ক্রয়াদেশ নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছিলেন তারা। দীর্ঘ সংকটাপন্ন পরিস্থিতি কাটিয়ে মূলত চলতি মাসেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাত। ক্রয়াদেশের দরকষাকষিতেও সুবিধাজনক একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। এ মুহূর্তে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন ক্রেতার কাছ থেকে ক্রয়াদেশ হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই এভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে অনেক শিল্প-কারখানা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে, লকডাউন বা শাটডাউন যাই হোক না কেন, তা নিয়ে সরকার যত কঠোর অবস্থানের কথাই বলুক না কেন-তার বাস্তবায়ন নিয়ে বিশ্লেষকদের সন্দেহ রয়েছে। তাদের মতে বিভিন্ন সময় লকডাউন বা বিধিনিষেধ কর্যকর করতে বেগ পেতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে। যেহেতু দেশের মোট জনগোষ্ঠীর তিন কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। পেটে ক্ষুধা থাকায় তাদের কোনো বিধিনিষেধ দিয়ে আটকে রাখা যায় না। শাটডাউন বা বিধিনিষেধ যাই বলা হোক, তা বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দরিদ্র বা নিম্নআয়ের মানুষসহ একটা বড় জনগোষ্ঠীর খাবারের যোগান নিশ্চিত করা। তাই এ মানুষকে গৃহবন্দি করতে হলে আগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঘরে খাবার নিশ্চিত করতে হবে।

এবিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ জাতীয় কারিগরি কমিটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, ঈদকেন্দ্রিক অবাধ চলাফেরায় সামনে অবস্থা আরো ভয়াবহ হতে পারে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে সংক্রামণ থেকে রক্ষা পেতে ঈদ পরববর্তী অন্তত ১৪দিন সবকিছু বন্ধ থাকা দরকার। এতে জরুরি ওষুধ এবং খাদ্য সরবরাহ ছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকবে। মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। তা না হলে আমরা এখন যে জীবিকার কথা বলছি, খাদ্যের কথা বলছি, তার জন্য লোক থাকবে না। জীবন না থাকলে জীবিকা দিয়ে কী হবে।

গত মাসের শেষের দিকে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রস্তাবিত ‘শাটডাউনের’ রূপরেখার কমিটির দায়িত্বশীলরা জানায়, যারা ওই প্রস্তাব দিয়েছেন তারা ‘কারফিউ’ অবস্থার কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে জরুরি সেবায় নিয়োজিত ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান, রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের বিপণিবিতান বন্ধ থাকবে। জরুরি কাজ ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য দোকান-বাজার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খুলে আবার বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর যৌক্তিক জরুরি কাজ ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হলেই শাস্তির মুখে পড়তে হবে। এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নে আগে যেহেতু সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন কাজ করেও সুবিধা করতে পারেনি, তাই এবার প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শক কমিটিতে জোর দিয়েই বলা হয়েছে, মাত্র ১৪ দিন যদি কার্যকরভাবে সব কিছু বন্ধ রাখা যায় তবেই সুফল মিলবে। তা না হলে সংক্রমণ দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং মৃত্যু বাড়বে।

সূত্র মতে, আগে লকডাউন দেওয়া হলেও বিভিন্ন মহল থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অঙ্গীকার করে সরকারের কাছ থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাত নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হওয়ার আগেই খোলার অনুমতি আদায় করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির এক সদস্য বলেন, এর আগে গত বছর প্রথম দফা লকডাউনেই ভালো সাফল্য মিলেছিল, কিন্তু পরের কোনো লকডাউনই পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। নানা কারণে মাঝপথে গিয়ে হাল ছেড়ে দিতে হয়েছে। আবার স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে যেভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়, সেটাও অন্যরা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করছে না। ফলে প্রতিবারই কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হলেও বাস্তবে দু-এক দিন পরে তা ঢিলে হয়ে যায়। তবে ঈদ পরবর্তী সময়ে সব কিছু বন্ধ রাখার সুপারিশ করছে কমিটি। এটাকে প্রি-শাটডাউন বলে তিনি অবহিত করেন।

জাতীয় পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ঈদ পরবর্তী বিপর্যয় এড়ানোর জন্য কমিটি সরকারের কাছে কার্যকর একটা পদক্ষেপ চায়। কারণ, এতদিন যে লকডাউন চলছে, তাতে অনেক অফিস শিল্প-কারখানা, দোকানপাট খোলা থাকে। তার ফলে এই লকডাউন দিলেও আমরা দেখছি যে, কাজের অজুহাতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তাঘাটে চলাফেরা করছে, কর্মস্থলে যাচ্ছে। তাতে যে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল সেটা কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। তাছাড়া লকডাউন এক সপ্তাহ করে বাড়িয়েই যাচ্ছে। যেখানে করোনা কমার কথা। কিন্তু সংক্রমণ কমে নাই, স্থিতি অবস্থাতেও নাই। এটা আরো বাড়ছে। সেজন্যে আগে থেকেই জাতীয় কারিগরি কমিটি শাটডাউনের কথা বলেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিনিয়ত তার রূপ পাল্টাচ্ছে অর্থাৎ তার মিউটেশন হচ্ছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেই চলমান প্রক্রিয়ায় নানা রকম স্ট্রেইনের কথা গবেষকরা জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে পেয়েছে। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, স্ট্রেইন যাই হোক না কেনো উপসর্গ বা লক্ষণ বা রোগের তীব্রতা কিন্তু একই রকম। কাজেই স্ট্রেইন নিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই ভ্যারিয়েন্ট নয় স্বাস্থ্যবিধি অবহেলার কারণেই সংক্রমণ বাড়ছে। মানুষের কাছ থেকে মানুষের মাঝে সংক্রমণ বন্ধ করাই এখন আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ।  আমাদের এটি রোধ করতেই হবে। এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ সরকারকে এখনই কঠোর ব্যবস্থায় যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!