• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
উজাড় বন বিপর্যস্ত পরিবেশ

পাহাড়ধসে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ৩১, ২০২১, ০৯:৫৭ পিএম
পাহাড়ধসে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

ঢাকা : ভয়াবহ পরিবেশদূষণের কবলে পড়ে শঙ্কায় বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ। জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে আজ পরিবেশ বিপর্যয়ের আতঙ্ক। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়সহ প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারে বিপন্ন পরিবেশে প্রায়ই ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ধস নজর কেড়েছে বিশ্ববাসীর।

পাহাড়ধস বন্ধে ২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর সরকারকে ১২ দফা সুপারিশ দিলেও তা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে গত দুইদিনে কক্সবাজারে চারটি পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে শিশুসহ ১৪ জন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০১৭ সালের জুনে পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ ধসে দেড়শর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ওই বছর মৌলভীবাজারে পাহাড়ধসের ঘটনায় সেখানেও প্রাণহানি হয়েছে।

পাহাড়ের জীবনযাপন ও প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি রাখা বন ও পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক দানেশ মিয়া বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান জনমানচিত্র ও জীবনযাপনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত এ পরিবেশকে আমরা মানুষেরাই নানাভাবে বিষিয়ে তুলেছি।

উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে রয়েছে-অত্যধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, দ্রুত শিল্পায়ন, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল্পকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোনস্তরের ক্ষয়, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দারিদ্র্য, প্রসাধনসামগ্রী, প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি।

পরিবেশদূষণ সমস্যা প্রকট হওয়ায় মানবসভ্যতা আজ মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত, চরম হুমকির মুখে, যা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে ভয়ংকর অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। এ অবস্থায় পাহড়ধস ঠেকাতে শূন্যের কাছাকাছি চলে যাওয়া প্রাকৃতিক বনকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

পাহাড় ধসের সাম্প্রতিক চিত্র : পাহাড়ধসে প্রাণহানির প্রকৃত চিত্র পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে সূত্র থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৬ সালে রাজবাড়ী ও লামায় ৭ জন, ২০০৩ সালে চট্টগ্রামে ১০ জন, ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ৫ জন, ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে ৩ জন, ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে ২ জন, ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের লেবুবাগান এলাকায় ১২৭ জন, ২০০৮ সালের আগস্টে চট্টগ্রামের মতিঝর্ণা এলাকায় ১১ জন, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৪ জন, টেকনাফের ফকিরামুরা ও টুন্যাতে ১৩ জন, ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট লামায় আজিজনগর ও গজালিয়ায় ১১ জন, ২০১০ সালে রামুতে ৬ জন, টেকনাফে ৩৩ জন, উখিয়ায় ৯ জন, হিমছড়িতে ৬ জন এবং কক্সবাজার সদর উপজেলায় ২ জন, ২০১১ সালে ১৭ জন এবং ২০১২ সালে লামার ফাইতং, রূপসীপাড়া ও লামা সদর ইউনিয়নসহ চট্টগ্রাম মহানগরে ৯০ জনের প্রাণহানী ঘটেছে।

গত মঙ্গলবার টেকনাফে দেশের সর্বশেষ ঘটে যাওয়া পাহাড়ধসের ঘটনায় মারা যায় ৫ জন। মধ্যরাতে ধসে পাহাড়ের মাটি এসে পড়ে একটি বসতবাড়ির ওপর। এতে চাপা পড়ে প্রাণ যায় ওই বাড়ির ঘুমন্ত পাঁচ শিশুর। এর আগে সোমবার গভীর রাতে মহেশখালীতে পাহাড়ধসে এক নারীর মৃত্যু হয়। ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের উত্তর সিপাহিপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। ওই নারীর নাম মোরশেদা বেগম। তিনি উত্তর সিপাহিপাড়ার আনছারুল করিমের মেয়ে।

স্থানীয়দের বরাত দিয়ে মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল হাই জানান, রাতে ভারী বর্ষণে পাহাড়ধসে ঘরের সীমানা দেয়াল ভেঙে যায়। এ সময় ঘুমন্ত অবস্থায় মোরশেদা চাপা পড়েন। সকালে তার মরদেহ পাওয়া যায়।

ওই পরিসংখ্যান থেকে পাহাড়ধসের ভয়াবহতাকে বোঝা না গেলেও এটি পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ধস একটি নিয়মিত পরিবেশগত দুর্যোগে পরিণত হয়েছে।

এদিকে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে আগামী ২৪ ঘণ্টায় অতি ভারি বর্ষণ এবং চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।

বুধবার (২৮ জুলাই) অধিদপ্তরের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বুধবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি (৪৪-৮৮ মিলি মিটার) থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এমন আশঙ্কায় নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে পরিবেশবিদদের।

অন্যদিকে ২০১৭ সালে সংসদ ভবনে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে জমা দেওয়া প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় ও টিলা সংরক্ষণে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ কঠোরভাবে প্রতিপালনের সুপারিশ করে। একই সঙ্গে পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন করে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড়ি এলাকায় পরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করার সুপারিশ করা হয়।

সুপারিশে অধিদপ্তর বলছে, পাহাড়/টিলার গঠনশৈলী, পাহাড়ি নদ-নদী-ঝর্ণা, স্থায়িত্ব, ধসে পড়ার ঝুঁকিগুলো, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, পাহাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর গৃহ ব্যবস্থা, পাহাড়নির্ভর জীবিকা ইত্যাদির ওপর গবেষণা/সমীক্ষা পরিচালন করে টেকসই পাহাড় ব্যবস্থাপনার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করতে হবে।

প্রতিবেদনে অধিদপ্তর বলছে, পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস ও ভূমি ক্ষয়রোধে বনায়ন, টেকসই কৃষির প্রবর্তন, পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। ম্যাপিং, জোনিংসহ পাহাড়ি এলাকার বিস্তারিত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা, পাহাড় সংরক্ষণ এবং পাহাড়ি এলাকার ব্যবহার সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তন/নিধন বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ব্যাপকহারে পাহাড়ের জন্য উপযোগী বনায়ন করতে হবে। পাহাড়ের গায়ে থাকা গুল্ম জাতীয় গাছ/জঙ্গল পোড়ানো বন্ধ করতে হবে।

আর সুপারিশে বলা হয়, পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা নির্মাণের সময় পাহাড়ের ঢাল কোনোক্রমেই যাতে ৩৫-৪০ ডিগ্রির বেশি না হয়। পাহাড়ের ঢালে সিমেন্ট ব্লক বসাতে হবে অথবা ঘাসের আচ্ছাদন লাগাতে হবে। পাহাড় কেটে সমান করে, পাহাড়ের ঢাল এবং পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। সুপারিশে পাহাড়ের অবৈধ বসতি স্থাপন নিরুৎসাহিত করার জন্য সেবা সংযোগ (বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি) প্রদান বন্ধ অথবা বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, পাহাড় ধস প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই কমিটি ৩৫টি সুপারিশ সংবলিত একটি প্রতিবেদন দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এরপর ২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর আবারো ১২ দফার সুপারিশ সরকারকে হস্তান্তর করলে বিগত সময়ে তার কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। ফলে এ মহাবিপর্যয় ঘটে। কার্যকর মনিটরিং তৎপরতা না থাকার সুযোগে পাহাড় কেটে বসতি ও পাহাড়ের চরিত্র বদলানোর কারণে ওই মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে।

বাংলাদেশের পাহাড়ধসের কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক দানেশ মিয়া  বলেন,  আশির দশক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতলের মানুষদের নেয়া হয়েছে। তাদের জনসংখ্যা বেড়ে অনেক হয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যা ট্রাইবাল কমিউনিটিজকে ছাড়িয়ে গেছে। থাকা ও খাওয়ার জন্য সেখানে তাদেরকে কৃষি কাজ করতে হয়। ঘরবাড়ি বানাতে হয়। তারা  সেটা পাহাড় কেটে করেন। পাহাড়িরা এখানে হাজার হাজার বছর ধরে থাকে। তারা জানেন, কীভাবে পাহাড়কে ক্ষতি না করে কৃষি কাজ করতে হয়।

কীভাবে পাহাড়কে ক্ষতি না করে ঘর বানাতে হয়। আমাদের সমতলের মানুষদের কিন্তু সেই জ্ঞান নাই। তাঁরা সেখানে সমতলের মতো করে ঘর বানাচ্ছে। পাহাড়কে কেটেকুটে সাবাড় করছে। এখানে পাহাড়কে আঘাত করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে চলে আসছে, যাতে বড় ধরনের বিপর্যয় হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!