• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভুঁইফোঁড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ১, ২০২১, ০৪:১২ পিএম
ভুঁইফোঁড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার

ঢাকা : আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সদস্য থেকে বহিষ্কৃত ও বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মকাণ্ডে আলোচিত হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে পল্লবী থানায় র্যাব বাদী হয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন এর ৩৫, ৫৫, ৭৩ ধারায় মামলাটি দায়ের করে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি জানান, এর আগে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।

এছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের চারটি ধারায় আরো একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তায় আইনে দায়ের করা মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে থাকা হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। তার বিতর্কিত সব কর্মকাণ্ড নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানিয়েছে।

তারা জানায়, বিগত সময়ের যত বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এগুলো নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি এগুলো নিয়ে তার কি উদ্দেশ্যে ছিল সেটাও জানতে চাওয়া হচ্ছে।

সূত্র আরো জানায়, রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর তাকে থানায় নিয়ে আসা হয়। পরে তাকে তার কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর শনিবার (৩১ জুলাই) বিকেলে আবারো তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়। এ সকল বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পেছনে উদ্দেশ্য, কার ইন্ধন এগুলো নিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : ২০০৯ সালের পর নামের আগে-পরে ‘আওয়ামী’, ‘লীগ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ যুক্ত করে যেসব সংগঠন গড়ে উঠেছে, এর প্রায় সবই ভুঁইফোড় বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সরকার।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এবিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের উদ্যোক্তাদের কর্মকাণ্ড ও সম্পদের খোঁজ নেওয়া হবে। সরকার বা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে কারা এসব সংগঠনের পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, সেটাও খোঁজা হবে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

এরআগে গত বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তাঁর মালিকানাধীন জয়যাত্রা আইপি টিভি ও জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের ভবনে অভিযান চালানো হয়। সূত্র বলছে, এর মাধ্যমে ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা শুরু হলো।

সমপ্রতি ফেসবুকে নেতা বানানোর ঘোষণা দিয়ে ছবি পোস্ট করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। এরপর তাঁকে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ থেকে বাদ দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ টানা তিনবার সরকার গঠন করেছে। প্রতিবার নির্বাচনের আগে বা সরকার গঠনের পর কিছু সংগঠন গজিয়ে ওঠে।

মূলত, মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া কিংবা বাদ পড়া এবং দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের কেউ কেউ এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকেন। কেউ আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ২০১৫ সালে দলের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে শতাধিক সংগঠনের তালিকা গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানায়।

এরপর কিছুদিন এদের তৎপরতা কিছুটা কমে যায়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে পুনরায় তৎপর হয়ে ওঠে। প্রচারের লোভে এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে গিয়ে দু-একজন মন্ত্রী-নেতা প্রতারিত হওয়ার কথাও দলের বিভিন্ন পর্যায়ে তুলেছেন।

সরকারি কর্মকর্তারাও ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতাদের তদবিরে অতিষ্ঠ হয়ে নালিশ করেছেন। এরপর সমপ্রতি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে পুনরায় ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, নামের আগে-পরে লীগ, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল এবং মুক্তিযুদ্ধ যুক্ত করে সারা দেশে গড়ে উঠা ভুঁইফোড় সংগঠনের সংখ্যা শতাধিক। এর বেশিরভাগই গত এক দশকে গড়ে উঠেছে। ফেসবুকে একটি পেজ কিংবা দিবসভিত্তিক কিছু ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে তারা তৎপর থাকে।

নামসর্বস্ব এসব সংগঠনকে আওয়ামী লীগের অনেকেই ‘রাজনৈতিক দোকান’ বলে মন্তব্য করেন। এসব ‘দোকানের’ আয়োজিত অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ হিসেবে আওয়ামী লীগের ডজনখানেক নেতা ও বর্তমান সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে দেখা যায়।

তাঁদের মধ্যে যারা মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই পাননি বা বাদ পড়েছেন, এমন নেতাদের বেশি দেখা যায়। কোনো কোনো ভুঁইফোড় সংগঠনের নাম নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে হাস্যরসে মেতে উঠতেও দেখা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের কার্যত কোনো কমিটি, কার্যালয় বা গঠনতন্ত্র নেই। কিছু সংগঠন ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে তাদের দলীয় কার্যালয় হিসেবে প্যাডে উল্লেখ করে থাকে।

‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের’ চেতনায় বিশ্বাসী উল্লেখ করে সুবিধা আদায় করার অভিযোগ আছে এসব কথিত সংগঠনের বেশ কয়েকটির বিরুদ্ধে। দিবসভিত্তিক অনুষ্ঠান বা চলমান রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনার নামে জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে অনুষ্ঠান ও মানববন্ধন কর্মসূচি দেখা যায়।

এবিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা মাঠে রাজনীতি করি। এসব ভুঁইফোড়, স্বার্থান্বেষীরা কখন কোথায় ছবি তুলে বসে, সেই আতঙ্কে থাকি।’

তিনি আরো বলেন, এসব ভুঁইফোড় সংগঠন আওয়ামী লীগকে বিব্রত করছে। তাদের বিরুদ্ধে দল কঠোর। আইনিব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নিতে দল থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরা দল বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধার ধারে না। নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী সংগঠন আটটি। এগুলো হচ্ছে যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ ও তাঁতি লীগ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে দুটি ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ।

এর বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর অনুমোদন নিতে হয়।

এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাসংক্রান্ত সংগঠনের ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) অনুমোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো অনুমোদনের ধার ধারে না।

এদিকে হেলেনা জাহাঙ্গীর কেন্দ্রীয় মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্যপদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সুপারিশে পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন দলের নেতারা।

এবিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এইটা (সুপারিশে পদ পেয়েছেন) কেউ বললে আমি কী করতে পারি?

আমি তাকে চিনি, ভালো জানি, তার সঙ্গে আমার খাতির আছে। সে সিআইপি, ৫-৬টা মিলের মালিক। তবে সে বেআইনি কিছু করলে আইন তার নিজস্বগতিতে চলবে। এখানে সম্পর্কের কোনো বিষয় নাই।’

মন্ত্রী বলেন, ‘তার মতো তো বহু লোককেই আমি চিনি, জানি। এর মধ্যে ভালো আছে, খারাপও আছে। তাই বলে অন্যের কাজের দায় তো আমি নেব না। কেউ বেআইনি কিছু করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

হেলেনা জাহাঙ্গীরের কর্মকাণ্ডে মন্ত্রী জড়িত নন দাবি করে বলেন, ‘তার (হেলেনা জাহাঙ্গীরের) আইপি টিভি বা কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই আমি জড়িত নই। আর থাকবোই বা কেন।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!