• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়বে সংক্রমণ বাড়বে বিপদ!


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ২, ২০২১, ১২:৪৯ পিএম
বাড়বে সংক্রমণ বাড়বে বিপদ!

ঢাকা : টানা ১২ দিন ছুটির পর রোববার (১ আগস্ট) চালু হয়েছে শ্রমিক-কর্মচারীসহ রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা। মাত্র একদিন আগে ঘোষণা দেওয়ায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে উপস্থিত হয়েছেন প্রায় ৯০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী।

তবে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে রক্ষা করতে এসব খাতে কর্মরত লাখো কর্মীকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এভাবে শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ায় ফের সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হঠাৎ রপ্তানিমুখী কলকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে কর্মরত শ্রমিকরা মারাত্মক ভোগান্তির সম্মুখীন হন।

একদিকে গণপরিবহন বন্ধ, অন্যদিকে কারখানায় কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশে তারা হতবিহ্বল হন। চরম ভোগান্তির শিকার হয়ে গ্রামে অবস্থান করা শ্রমিকরা যে যেভাবে পেরেছেন, সেভাবেই কর্মস্থলে পৌঁছান। কিন্তু তাদের এ যাত্রা পথে স্বাস্থ্যবিধির ধার ধারেনি কেউই।

ঢাকার বাইরে যেভাবে সংক্রমণ বেড়েছিল ঠিক একইভাবে এখন ঢাকায় বাড়বে। আমরা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে রাজধানীর সংক্রমণ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

চলমান লকডাউনে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সব কারখানা বন্ধ থাকবে, সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার এই বিষয়টি নিশ্চিত করা হলেও ৩০ জুলাই বিকেলে প্রজ্ঞাপন মাধ্যমে হঠাৎ করেই ১ আগস্ট থেকে কারখানা খোলার ঘোষণা দেয় সরকার।

চলমান বিধিনিষেধে শ্রমিকরা, যারা ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন, তারা দূর-দূরান্ত থেকে কীভাবে কর্মস্থলে ফিরবেন, তার কোনো নির্দেশনা নেই ওই প্রজ্ঞাপনে।

যদিও মালিকদের সংগঠনগুলো বলেছিল, যেসব শ্রমিক কাছাকাছি দূরত্বে আছেন, তাদের নিয়েই আপাতত উৎপাদন শুরু করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় পরিস্থিতি পুরোই উল্টো।

পরদিন শনিবার শ্রমিকদের ঢাকামুখী যাত্রার যে চিত্র দেখা গেছে, তাতে করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি তো বটেই, প্রশ্নের মুখে পড়েছে তাদের প্রতি সরকার এবং শিল্পমালিকদের দায়িত্ববোধের বিষয়টিও। শ্রমিকরা কারখানা খোলার বার্তা পেয়ে যান। কারখানা খোলা অবস্থায় অনুপস্থিত থাকলে বেতন হারানো, এমনকি চাকরি হারানোর ভয়ে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলের দিকে ছোটেন।

এদিন কারখানাগুলোতে ৮৫ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ শ্রমিক উপস্থিত হয়েছে বলে মনে করছে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও নিটওয়্যার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, গতকাল প্রথমদিন বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত পোশাক কারখানায় ৯০ শতাংশ শ্রমিক উপস্থিত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তারা কাজও শুরু করেছেন।

কখনো ভাঙাপথে, কখনো পায়ে হেঁটে মানুষের যে ঢল রাজধানীমুখী হয়েছে তাতে করোনা সংক্রমণের জন্য আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ভাঙাপথে পাঁচটি অংশে পাঁচটি যানবাহনে উঠলে একজন মানুষকে অন্তত পাঁচজন মানুষের পাশে বসতে হয়। ফেরিতে গাদাগাদি করে পার হওয়া তো আরো ভয়াবহ। তাই এসব শ্রমিকের কর্মস্থলে ফেরাকে আগে সহজ না করে অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা খোলায় বিপদ ঘরে টেনে আনার সঙ্গে তুলনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, সরকারের সর্বশেষ এ সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবে সংক্রমণের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। হঠাৎ করে এভাবে কারখানা খুলে দেওয়ায় এই খাতে কর্মরত কয়েক লাখ কর্মীকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হলো। এখন কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। নইলে সামনে করোনা সংক্রামণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

জনস্বাস্থ্যবিদ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, আমরা এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছি। কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছি না।

তাই আশঙ্কা করছি, মানুষ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধির কোন তোয়াক্কা না করে চলাফেরা করছে, তাতে সামনের দিনগুলো এ সংক্রামণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এখন সরকারকে দ্রুত এসব শ্রমিকদের টিকার আওতায় আনার পরমার্শ দেন তিনি।

করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের ভুলের কারণে মানুষ মরছে বলে মন্তব্য করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সরকার আজ যেটা বলছে কাল সেটা মানছে না। সরকার লকডাউন দিয়েছে আবার নিজেই বিধিনিষেধ মানছে না। এমনকি লকডাউনের বিধিনিষেধের বেড়াজালে গরিব মানুষের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, কলকারখানা খোলার ব্যাপারে কতগুলো নিয়ম আছে। শ্রমিকদের টিকা দিতে হবে। টিকা দেওয়া কঠিন কোনো কাজ না। গার্মেন্ট মালিকদেরও দায়িত্ব আছে। যে শ্রমিকদের কাঁধে ভর করে মালিকরা এত কিছু করেছেন, সেই শ্রমিকদের তো টিকা দিয়েই কারখানা চালাতে পারেন। টিকার টাকা তারাই জোগাড় করে দিতে পারেন।

তিনি বলেন, ৫ আগষ্ট পর্যন্ত লকডাউন দিয়ে সাধারণ এসব মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গ্রামে পাঠানো হলো। আবার গণপরিবহন বন্ধ রেখে শিল্পকারখানা চালু করা হলো। এটা তো শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা নিয়ে তামাশা করা হচ্ছে।

মানুষ লকডাউনের মধ্যে যেভাবে গ্রামে গেল, মেলামেশা করল, আবার গাদাগাদি করে ঢাকায় এলো, তাতে সবার মাঝেই এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।

এদিকে লকডাউনের মধ্যে পরিবহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না করে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দিয়ে শ্রমিকদের হয়রানি করানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ‘শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম’।

সংগঠনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, লকডাউন সময়ে শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রেত।

কারখানা খোলার খবরে গত বছরের মতো আবারো কয়েক লাখ শ্রমিক গণপরিবহনের অভাবে পায়ে হেঁটে, রিকশা, ভ্যান, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ নানাভাবে দুর্ভোগ সহ্য করে কারখানা অঞ্চলগুলোতে আসছেন।

করোনার এ ঊর্ধ্বগতির সময়ে কোনোরকম স্বাস্থ্যসম্মত পরিবহন এবং জীবনের নিরাপত্তা ছাড়া এভাবে শ্রমিকদের আসা-যাওয়া করতে বাধ্য করার তীব্র নিন্দা জানয় সংগঠনটি।

অন্যদিকে শ্রমিকের এভাবে ফেরার দায় নিলেন না সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ী নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কারখানার আশপাশের শ্রমিকদের নিয়ে প্রথমে কারখানা চালু করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের দ্রুত কাজে যোগ দেওয়ার নোটিশ দেয়। শ্রমিকদের আনা হয়েছে সারা দেশ থেকে। এতে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে মানুষের রাজধানীমুখী যে স্রোত, তাতে সংক্রমণের হার বেড়ে যেতে পারে। এই ঘটনায় দায় শিল্পমালিকদের। তারা সরকারকে দেওয়া তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।

এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঢাকা ফেরার চাপ সামলাতে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে গণপরিবহন চালু করা হয়েছে।

কারণ শুক্র ও শনিবার রাতে ঢাকার পথে প্রচণ্ড চাপ ছিল গার্মেন্ট শ্রমিকদের। এটা দেখে এদেরকে যেন ঢাকায় নিয়ে আসা যায় সেজন্য একটা সাময়িক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এটা কতক্ষণ অব্যাহত থাকবে সেটা কেবিনেট ডিভিশন জানে। বিধিনিষেধের সিদ্ধান্ত যেখান থেকে আসে এবং শিথিল করে এ বিষয়ে সেখানকার কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন।

আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, রোববার থেকে গার্মেন্ট খুলে দেওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু তারা স্বাস্থ্যবিধি মানেননি। ফলে করোনা সংক্রমণ আরো বাড়বে।

তিনি বলেন, দেশে করোনায় আক্রান্তদের ১ দশমিক ৬ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে। আমাদের জীবনের জন্য জীবিকার দরকার আছে। আবার জীবিকার জন্য তো জীবনও থাকতে হবে। আমাদের এই দুটো ব্যালেন্স করতে হয়। সরকারের সে ব্যালেন্স করে চলতে হয়; কিন্তু ব্যালেন্স সবসময় রাখা যায় না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!