• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যতটুকুতে হুমকি নেই ততটুকু আন্দোলন...


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ২৫, ২০২১, ০৯:২৮ পিএম
যতটুকুতে হুমকি নেই ততটুকু আন্দোলন...

ঢাকা: প্রায় দেড় বছর করোনায় স্থবির ছিল জনজীবন। রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সবখানে মহামারির প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। কিছুদিন ধরে করোনা সংক্রামণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এবং একইসঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং চলমান ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে কিছুটা উত্তাপ চলছে। বিশেষ করে বিরোধী সব দলই সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদারের মাধ্যমে চাঙ্গা করতে চাচ্ছে আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্র। 

আরও পড়ুন: আন্দোলনের রূপরেখা সাজিয়ে ফেলেছে বিএনপি

তবে সরকারি দল এক্ষেত্রে বেশ সতর্ক।রাজনীতিকদের কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার যতটুকু আন্দোলন করলে তাদের ক্ষমতা রক্ষার হুমকি হবে না বলে মনে করছে, ততটুকু করতে অনুমতি দিচ্ছে অথবা নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিরোধীদের ততটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সরকার এবং আওয়ামী লীগের এ অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাজমান স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না বিরোধী দলগুলো।

আরও পড়ুন: হাকডাক দিচ্ছে বিএনপি, পাত্তা দিচ্ছে না আ.লীগ

আবার বিরোধী দলগুলোর অনেক নেতারাই একই পন্থার রাজনীতিতে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছেন বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।বিশেষ করে যারা বিগত দিনে ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে কাড়ি কাড়ি টাকা পয়সার মালিক হয়েছেন, গড়েছেন একাধিক ব্যবসা-বাণিজ্য। তাদের ক্ষেত্রেও ওই একই উক্তি ‘যতটুকুতে হুমকি নেই ততটুকু আন্দোলন’। ‘বলে যান যত খুশি, করতে গেলে বুঝে শুনে’ রাজনীতির এই বিশেষ কথনে বিশ্বাসী এসকল নেতারা।

আরও পড়ুন: আন্দোলনের নতুন টিম বানাচ্ছে বিএনপি

এমন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিগত অর্ধযুগেরও বেশি সময় থেকে মাঠের রাজনীতি অনেকটা গৃহবন্দি। মাঝে মাঝে সরকারি দল আওয়ামী লীগ মাঠে বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচি পালন করলেও, বিরোধী দলের রাজনীতি প্রেস রিলিজ, দলীয় কার্যালয়, প্রেসক্লাবের হলরুম কিংবা সামনেই সীমাবন্ধ।

আরও পড়ুন: জোটগত রাজনীতিতে নতুনত্ব নিয়ে আসছে বিএনপি 

সম্প্রতি প্রেসক্লাবে রাজনৈতিক সমাবেশ ও কর্মসূচি বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে বিগত দুই-তিন বছর থেকে দলীয় স্বার্থ কিংবা গণইস্যু নিয়ে কোনো জোরালো আন্দোলন নেই। অবশ্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের অভিযোগ, কোনো গণইস্যু নিয়ে তাদের মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। মাঠে নামলেই তাদের ওপর ধরপাকড়, নির্যাতন নেমে আসে। প্রশাসন ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা সম্মিলিতভাবে চালান দমন-নিপীড়ন। তারপরও তারা রাজপথে থাকার চেষ্টা করছেন। তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, রাজপথে নামার শক্তি নেই বিরোধী দলগুলোর। তাই তারা এসব কথা বলছে।

আরও পড়ুন: সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা তারেক রহমানের হাতে

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর ৪৪টি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আদালতের আদেশে এবং ইসির শর্ত পালনে ব্যর্থ হওয়ায় পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়। বর্তমানে নিবন্ধিত দল রয়েছে ৩৯টি। যার মধ্যে বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ আটটি দলের প্রতিনিধিত্ব আছে। এর বাইরে দেশে শতাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। তবে মাঠে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী দল হিসেবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)সহ বেশ কয়েকটি দল সরকারবিরোধী হিসেবে মাঠে সক্রিয় রয়েছে।

আরও পড়ুন: একটি কৌশলে মিল দু’দলে

ভোটের সময় জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, বিকল্প ধারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করলেও, ভোট শেষে তাদের সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতে দেখা যায়। অন্য দিকে জামায়াতে ইসলাম নিবন্ধন হারিয়ে অনেকটা মাঠছাড়া। বিগত কয়েক বছর থেকে রাজনীতির মাঠে তাদের খুব একটা দেখা মিলছে না। 

আরও পড়ুন: অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে কাজ শুরু করেছে আ.লীগ

বিগত ১০ বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দশম নির্বাচনের পূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠ গরম করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো; কিন্তু তা পাত্তা না দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি এই নির্বাচন সম্পন্ন করে আবার ক্ষমতাসীন হন আওয়ামী লীগ। তবে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সেই নির্বাচন বয়কট করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। ভোটের পর প্রায় একমাস হরতাল-অবরোধ করে বিএনপি জোট। এরপর নানা আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে জোরালো আন্দোলন করতে পারেনি বিএনপিসহ সরকারবিরোধী জোটের দলগুলো। পরবর্তী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বয়কট করে বিরোধী শিবিরের দলগুলো। এরপর একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামে বিএনপি; কিন্তু দাবি আদায় করতে পারেনি তারা।

আরও পড়ুন : জামায়াতের মাস্টারপ্ল্যান ফাঁস

সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে ভরাডুবির কবলে পড়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট। ৩০০ আসনের মধ্যে জোটটি জয়লাভ করে মাত্র ৭টি আসনে। আর সেই নির্বাচনে জয়লাভ করা তো দূরের কথা, সব আসনেই জামানত হারায় ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’। জাতীয় পার্টি এই দুই নির্বাচনে জোট করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। একাদশ নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে আবার নির্বাচনের দাবি তুলে নানা কর্মসূচি দিলেও কোনোটাই সফল করতে পারেনি ঐক্য ফ্রন্ট কিংবা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট। এরপর আর কোনো জোরালো আন্দোলন দেখা যায়নি বিরোধী শিবিরের এই দুটি জোটকে। করোনাকালীন তাদের সক্রিয়তা অনেকটা নেই বলে দাবি রাজনৈতিক সচেতনদের।

আরও পড়ুন: এবার আর হায়ারে খেলবে না বিএনপি

মাঝে মধ্যে বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নামলে সংঘর্ষে জড়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি দলের সঙ্গে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই ৯ মাসে সারাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন। নিহতের এ সংখ্যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। গত বছর সারাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতে ৩১ জন নিহত হয়েছেন। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে নিহত হয়েছেন পাঁচজন। চলতি বছরের ৯ মাসে সারাদেশে ৩২১টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন চার হাজার ৪০৫ জন। এ সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৬টি। তাতে ৭২ জন আহত হয়েছেন। আর মারা গেছেন তিনজন।

আরও পড়ুন: প্রভাবশালী নেতাদের কাছে জিম্মি বিএনপি

সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, উল্লিখিত সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর ভেতরে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা বেশি। মোট সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৮৩টি। তাতে নিহত হয়েছেন ১২ জন, আর আহত হয়েছেন ৯৬৯ জন।

বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে চারটি। আহত হয়েছেন ১০ জন। নিহত হয়েছেন একজন। তবে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ১৮টি। আহত হয়েছেন ৫৫০ জন। এ দিকে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে ৯টি। নিহত হয়েছেন পাঁচ এবং আহত ৮৭ জন।

আরও পড়ুন: ইসলামী দলগুলো একজোট হলে হতে পারে ভিন্ন কিছু

চলতি বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। কয়েক ধাপের ইউপি নির্বাচনে ১৬৭টি সংঘাতের ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক হাজার ৯৪২ জন। পৌর নির্বাচনে ১০টি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। তাতে নিহত হয়েছেন একজন এবং আহত হয়েছেন ১১৮ জন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৬টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন তিন এবং আহত ১৬২ জন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, জাসদসহ আরও অনেক ছোট ছোট রাজনৈতিক দলও সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। 

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘গণতন্ত্রবিহীন রাষ্ট্রে রাজনীতি স্থবিরতো থাকবেই। এদেশে মানুষের প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে ফ্যাসিবাদী সরকার কখনো চিরস্থায়ী হয় না। তদের পরিণতিও ভালো হয় না।’ 

আরও পড়ুন: ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ তকমা ঘোচাতে চায় নেতাকর্মীরা

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘রাজনীতিতে স্থবিরতা চলছে। সরকারি দল রাজনীতিতে নেই, তারা সরকার পরিচালনায় ব্যস্ত। অপরদিকে বিএনপি নেত্রী মুচলেকা দিয়ে রাজনীতিতে মুখ খুলছে না। অপর এক নেতা দোষী সাব্যস্ত হয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন; কিন্তু দেশ ও মানুষের অধিকার নিয়ে রাজনীতির মাঠে আছে জাতীয় পার্টি।’ 

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সরকার বিরোধীদলকে রাজপথে নামতে দিচ্ছে না। তাই বলে আমরা ঘরে ঢুকে যাইনি। আমরা ঠিকই রাজপথে আছি। সরকার যদিও গণমানুষের কণ্ঠরোধ করার সব চেষ্টা করছে; কিন্তু মানুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। যখনই পারছি সরকারের বিধিনিষেধ ভেঙে আন্দোলন করার চেষ্টা করছি। এটা চলবে।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘সরকার যতটুকু আন্দোলন করলে তাদের ক্ষমতা রক্ষার হুমকি হবে না বলে মনে করছে, ততটুকু করতে অনুমতি দিচ্ছে। বিরোধী দলের বড় ধরনের কর্মসূচি থাকলে সরকার নানা বিধিনিষেধ দিচ্ছে। দমন-নিপীড়ন এখন অন্যান্য যে কোনো সময়ের থেকে বেশি। বিরোধী সব দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও সরকারি দল ও পুলিশ হামলা করছে। তাই ফ্যাসিবাদী সরকারকে হঠাতে অনেক কিছুর মোকাবেলা করতে হবে।’

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!