• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
৩৭ মৃত্যুকে বলা হচ্ছে ভোটের ‘ঝগড়াঝাঁটি’

দ্বন্দ্ব গড়াবে জাতীয় নির্বাচনে


বিশেষ প্রতিনিধি নভেম্বর ১৫, ২০২১, ১১:৪৮ এএম
দ্বন্দ্ব গড়াবে জাতীয় নির্বাচনে

ঢাকা : স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)-এর দুই ধাপের নির্বাচনে সহিংসতায় ৩৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অনেক এলাকায় তৃণমূলে ভাঙন সৃষ্টির হয়েছে।

এ নির্বাচনকে ঘিরে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও বিভক্তি লক্ষ করা গেছে। ফলে ৭৪৫টি ইউপির ভোটের মধ্যে ২০৬টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।

এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন শেষ হলেও এখনো থামেনি সহিংসতা। এ সহিংসতায় প্রাণক্ষয়ের ঘটনাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে একে ঝগড়াঝাঁটি বলে চালিয়ে দিচ্ছে সরকার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সহসা শেষ হওয়ার লক্ষণ নেই। দুই ধাপের ইউপি নির্বাচনে ভোটে আওয়ামী লীগ ছাড়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। তারপরও নির্বাচনি সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

যারা ভোটের মাঠে সহিংসতা করেছে তারা আগে মাঠ থেকে বিরোধীদের হটিয়ে দিয়েছে। ফাঁকা মাঠে তারা নিজেরাই ভীষণ অসহিষ্ণু ও উগ্র হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। ফলে  ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের এ প্রভাব দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়বে।

এদিকে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে যায়। এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাদের স্বার্থরক্ষায় খুনোখুনির শিকার হন কর্মীরা। ভোটের মাঠে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে নৌকার প্রতিপক্ষ হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। প্রার্থীর কারণে অনেক স্থানে সংসদ সদস্যরাই সরাসরি নৌকার বিরোধিতা করছেন।

তৃণমূলের নেতারা বলছেন, ভোটের মাঠে বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রকাশ। তৃণমূল আওয়ামী লীগের এই বিভক্তি ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে, যা আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা।

বৃহস্পতিবার ৮৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে সাতজনের।

এর মধ্যে নরসিংদীতে তিনজন, কুমিল্লায় দুজন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে একজন করে মারা গেছেন।

এর আগে ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম দফার ভোটে মারা যান ছয়জন।

এরপর থেকে ভোটের মাঠের প্রচারণায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে আরো ২৪ জনের। সব মিলিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন অপ্রীতিকর ঘটনা ও সহিংসতা বন্ধে আপনি পুলিশকে কী নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইউপি নির্বাচনে সবসময় একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েই থাকে, এবারো তাই হয়েছে। তারপরও পুলিশের কাজ পুলিশ করছে। আমাদের বিশাল এলাকা নিয়ে নির্বাচন হচ্ছে। এটা গোষ্ঠী-গোষ্ঠীর নির্বাচন, আধিপত্যের নির্বাচন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ‘ঝগড়াঝাঁটি’র মন্তব্য বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে তারা এই নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। ৩৭ জনের মৃত্যুর পর এটা কীভাবে ঝগড়াঝাঁটি হয়! তার বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, মারামারি করে যে জিতে আসত পারবা সে আমার। আগামী নির্বাচনে তোমাকে আমার কাজে লাগবে।

তিনি বলেন, এটা তো নির্বাচনি সহিংসতা না, এটা ক্ষমতা দখলের সহিংসতা। এখানে যে নির্বাচিত হতে পারবে, সে তত বেশি লুটপাট করতে পারবে। এখন নির্বাচন করছে কারা?

এদের লুটপাটের না হয় জবরদখলের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্যই তো তাদের নির্বাচিত হওয়া দরকার। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতাশীলদের আধিপত্যের দ্বন্দ্ব দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত গড়াবে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে দশম ইউপি নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে নৌকার সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তথা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীর।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত ৮৩৪ ইউপি নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে ৪৮৬টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছেন। বিপরীতে ৩৪৮টি ইউপিতে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্রসহ অনান্য দলের প্রার্থীরা। তবে স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচিতদের ২০৬ জনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।

চূড়ান্ত ফলাফল অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ থেকে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন ৪৮৬ জন প্রার্থী। স্বতন্ত্র থেকে থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ৩৩০ জন।

বিরোধী দল জাতীয় পার্টি থেকে ১০ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে চারজন এবং জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), খেলাফত মজিলিশ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের একজন করে প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

এদিকে ভোট শেষেও এখনো থামেনি সহিংসতা মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও শেরপুরে ভোটের পরদিন শুক্রবারও চলে সংঘর্ষ।

শনিবারও (১৩ নভেম্বর) দেশের অনেক এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এর আগে ভোটের দিন বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ হয়। যদিও তৃণমূল পর্যায়ের এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। তবে সহিংসতার ঘটনায় ভোটের পরিবেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

অন্যদিকে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের এই দ্বন্দ্বকে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের জন্য হুমকি মনে করছেন না দলের নেতারা।

তারা বলেন, দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান একদিনে তৈরি হয়নি। স্বাধীনতার আগে-পরে নানামুখী আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-জুলুম, বিরোধীদের অত্যাচার-নির্যাতন ও কর্মীদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আজকের অবস্থানে এসেছে। যদিও স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন্দ্র করে তৃণমূলের কিছু কর্মী সমর্থকরা বিভক্ত হয়ে পড়ছেন। এমন অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে দায়িত্বশীল নেতাদের আরও সতর্ক ও সচেতন হবে বলে মনে করছেন তারা।

মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম বলেন, বিদ্রোহী দমনে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর নির্দেশনা নয়- মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড. সুবল চন্দ্র সাহা বলেন, বিএনপি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে না এলেও তারা ভোটের অংশ নিচ্ছে। অথচ তাদের মাঝে কোনো হানাহানি নেই। কিন্তু কিছু কিছু স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজেরা নিজেরা হানাহানি করছেন। মারামারি করছেন। দলের অভ্যন্তরে ভিন্নপন্থিরা অনেকেই অনুপ্রবেশ করে আওয়ামী লীগ সেজে আছে। এ অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় নেতাদের তৃণমূলে সৃষ্ট সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান করতে উদ্যোগ নিতে হবে।

বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান মজনু বলেন, যেকোনো নির্বাচনের তুলনায় এবার ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনে আমাদের (আ.লীগ) নেতাকর্মীদের মাঝে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

তৃণমূলের সবাই মনে করেন, দল ক্ষমতায় রয়েছে। নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেলেই বিজয় নিশ্চিত। এমন ধারণা থেকে মনোয়নের জন্য দলীয় নেতাদের মাঝে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মতে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য অনেক।

আশা করি, চলমান প্রতিযোগিতা জাতীয় নির্বাচনে তেমন প্রভাব ফেলবে না। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক দল।

এটাকে ভোটের সহিংসতা না বলে আধিপত্যের লড়াইয়ের সহিংসতা বলাই ভালো মন্তব্য করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখানে নির্বাচিত হতে পারলে তো নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা, লুটপাটের ভাগিদার হওয়া যাবে। ফলে তারা সর্বশক্তি নিয়ে নির্বাচনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে আধিপত্যের লড়াইয়ে যে টিকে থাকতে পারবে সেই সুবিধাগুলো পাবে। আর এদেরকেই জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী প্রর্থীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ আধিপত্যের লড়াই নিরসনে কাজ করেনা সরকারি দলের নেতা-কর্মীর।   

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ব্রতী’র নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ বলেন, বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনে এলে তখনও হয়তো এই ধরনের সহিংসতা হতে পারত। কিন্তু এত সহিংসতা আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেখিনি।

কিন্তু এখানে যে বিষয়টা লক্ষ্যণীয় যে, যারা ভোটের মাঠে সহিংসতা করছে তারা আগে মাঠ থেকে বিরোধীদের হটিয়ে দিয়েছে। ফাঁকা মাঠে তারা এখন নিজেরাই ভীষণ অসহিষ্ণু ও উগ্র হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে।

এই পরিস্থিতি এখন কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটাই প্রশ্ন। তবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেনে আসবে না বলে তিনি মনে করেন।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃণমূল আওয়ামী লীগে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে দল ও দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর সকল ইউনিটির নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। এ জন্য নির্বাচনকেন্দ্রিক সৃষ্ট সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছে দল।

বিশেষ করে বিদ্রোহীদের দল থেকে বহিষ্কার করা, দলের শীর্ষ পদে না রাখা, মনোনয়ন না দেয়া। একজন রাজনৈতিক কর্মী বা নেতার জন্য এটিই বড় শাস্তি বলে মনে করছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।

উল্লেখ্য, বর্তমানে সারা দেশে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ইতিমধ্যে নয় বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে প্রথম ইউপি নির্বাচন এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে নবম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০৩, ২০১১ ইউপি নির্বাচন হয়েছে। চলতি ২০২১ সালে জুন জুলাই মাস থেকে শুরু হয়েছে দশম ইউপি নির্বাচন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!