• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
সিদ্ধান্তে অনড় বিএনপি-আ.লীগ

রাজনীতিতে সংঘাতের নতুন শঙ্কা


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ৩, ২০২২, ০২:২৬ পিএম
রাজনীতিতে সংঘাতের নতুন শঙ্কা

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা : রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সংলাপ ঘিরে ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার হয়ে উঠছে দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান।

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে এ সংলাপে জাতীয় পার্টি, জাসদ ও গণফোরাম অংশ নিলেও রাষ্ট্রপতির এ আহ্বানকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে অনড় অবস্থানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ তাদের মিত্র দলগুলো। এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন গঠন থেকে নির্দলীয় সরকার বাস্তবায়নকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি মীমাংসিত। এখন এ সিদ্ধান্ত বদলের আর কোনো জায়গা নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য সংলাপ ও সার্চ কমিটি করে কোনো লাভ হবে না। এবারও বিএনপি আন্দোলনে গেলে দেশ তো কিছু অস্থিতিশীল হবেই। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে।

গত ২০ ডিসেম্বর থেকে রাষ্ট্রপতির সাথে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শুরু হয়। প্রথম দিনে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ করেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ। ২২ ডিসেম্বর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

রোববার (২ জানুয়ারি) বঙ্গভবনে এ সংলাপে গণফোরাম অংশ নিলেও যাননি দলের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন।

বিএনপিসহ মোস্তফা মহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরামের একাংশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

অন্যদিকে নতুন বছরে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে চায় বিএনপি। আসছে জুনের মধ্যেই সরকার পতন আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিতে আসতে পারে হরতাল-অবরোধ কিংবা তার চেয়েও কঠোর কর্মসূচি।

তবে লক্ষ্যে পৌঁছতে দলীয় কোন্দল ও কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধের পাশাপাশি নিজেদের শোধরানোকেও নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ বলছেন কেউ কেউ। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও রাজপথে যে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে মরিয়া বিএনপির তৃণমূলের নেতারা।

প্রায় দেড় দশকেরও বেশি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। পুরোটা সময়জুড়ে নানা ইস্যুতে আন্দোলনের ডাক দিয়েও ফল ঘরে তুলতে পারেনি দলটি। গেল বছরের প্রায় পুরোটা চেয়ারপারসনের মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে আন্দোলন করলেও তাতেও সফল হয়নি দলটি। তবে লক্ষ্যে পৌঁছতে এবার নতুন কৌশলে কঠোর আন্দোলনের চিন্তা করছে বিএনপি ও মিত্র দলগুলো।

দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি স্পষ্টতই ৯ বছর আগে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-পরবর্তী অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। সে সময় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কথার লড়াইয়ের পর সংঘাতে জড়ায় দুই পক্ষ। এতে ঝরে বহু প্রাণ, সম্পদহানি ছিল ব্যাপক।

দুই পক্ষই আবার অনড় অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়ার পর প্রায় এক দশক আগের অচলাবস্থা ফিরে আসছে কি না, এ নিয়ে আলোচনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বিষয়টি কেবল কথার লড়াইয়ে সীমিত নয়, হবিগঞ্জের শায়েস্তানগরে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষের পর সিরাজগঞ্জে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সংঘাতে জড়ানোর ছবি এসেছে গণমাধ্যমে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বাকি আর দুই বছরের মতো। এরই মধ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্টতই ঘোষণা দিয়েছেন ফয়সালা হবে রাজপথে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আন্দোলন হবে আন্দোলনের মতো। আন্দোলন হবে সত্যের জন্য, মুক্তির জন্য। দেশটা এখন একজনের হাতের ইশারায় নাচছে। ডিজিটালি মৃত্যু হচ্ছে। মানুষ পঙ্গু হয়ে আছে। সেই পঙ্গুত্ব থেকে উতরাতে হলে কঠোর আন্দোলনে যেতেই হবে।

আন্দোলন হলে আবার সহিংসতা, মানুষের প্রাণহানি, সম্পদ নষ্ট হবে- এ বিষয়টি তুলে ধরলে গয়েশ্বর বলেন, ‘পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে আমরা যুদ্ধ করিনি? স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করা হয়নি?’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মোহাম্মদ শাহজাহান ওমর বীর উত্তম বলেন, আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ একদিনে হয় না। ২০২২ সালের জুন মাসের আগেই এবার আমাদের আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমরা জনগণ এবং প্রশাসন থেকে যে সাড়া পাচ্ছি তাতেই বোঝা যাচ্ছে জুনের মধ্যেই এসপার ওসপার কিছু একটা হয়ে যাবে।

দলটির নেতা মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম বলেন, নতুন বছরে সরকারকে ক্ষমতা ত্যাগে যা যা করা প্রয়োজন তার সবই আমরা করব। বেগম জিয়াকে এই সরকারের আর বিদেশে পাঠানোর দরকার নেই। এমনও হতে পারে তিনি একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, আমাদের দলের কৌশল এবং অন্যান্য কিছু সমস্যা রয়েছে। নিজেদের দলের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করতে হবে। সমন্বয়হীনতা আমাদের আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এজন্য আমাদের ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল এবং বিএনপিকে একটি ঐকমত্যে আসতে হবে। অনেক জায়গায় তারা বিভক্ত।

বিএনপির সংসদ সদস্য জি এম সিরাজ বলেন, সরকারকে হয় জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে নয়তো বাকশাল ঘোষণা করতে হবে। আগে বাকশাল ঘোষণার পর কী ঘটেছিল, ইতিহাস কী বলে সেটি আওয়ামী লীগের দেখা উচিত। ২০২২-ই হবে এই সরকারের বিদায়ের বছর।

বিএনপির এই হুমকির জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, আন্দোলন বিরোধী দল করতেই পারে। কিন্তু আন্দোলনের নামে কেউ যদি গান পাউডার দিয়ে বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়, বাসে অন্তঃসত্ত্বাকে পুড়িয়ে মারে, সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারে, তাহলে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ তা প্রতিহত করবে। আওয়ামী লীগ জনগণের দল। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী লীগ যা করণীয় তা-ই করবে।

আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি মীমাংসিত। এখানে বদলের আর কোনো জায়গা নেই। তারপরেও মনে হচ্ছে বিএনপি ২০১৩-১৪ সালের মতো দেশে অগ্নিসন্ত্রাস করতে পারে। যদি তারা এমনটা করতে যায়, তাহলে আমরা তাদের রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করব।

ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য সংগ্রাম আরও জোরদার করার কথা জানিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপে যাওয়ার কোনো যুক্তি দেখছি না।

রাষ্ট্রপতি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এমন একজনকে নিয়োগ দিলেন বা দিতে বাধ্য হলেন, যে ব্যক্তি ৩০ তারিখের নির্বাচন ২৯ তারিখ রাতে করে প্রহসনের একটা কুৎসিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

তাই রোববার (গতকাল) নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংলাপে সিপিবি রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে যেতে রাজি হয়নি। তবে সংলাপে অংশ না নিয়ে একটি চিঠিতে ‘নির্বাচন কমিশন আইন’ প্রণয়নে রাষ্ট্রপতিকে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সিপিবি।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতি একটা ভুল মানুষকে নিয়োগ দেওয়ার ফলে বড় সমস্যা হয়েছে। এটার জন্য আমি আশা করি তিনি দুঃখিত হবেন।

কিন্তু তিনি তো মানুষকে বলবেন যে, আমি দুঃখিত, আমি ভুল মানুষকে নিয়োগ দিয়েছিলাম। তাহলে না বুঝবো যে গতবারের চেয়ে এবার ব্যতিক্রম কিছু হবে। কিন্তু তিনি তা করেননি।

রাষ্ট্রপতি পরামর্শ চান কিন্তু আমাদের পরামর্শ কার্যকর করার এখতিয়ার তার নেই। তাকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করতে হয়। এর বাইরে কারো পরামর্শ বা নিজের বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

তিনি বলেন, যেসব বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আমরা সেসব বিষয় গতবার আলোচনা করে এসেছি। নতুনভাবে কোনো বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনার প্রয়োজন মনে করছি না।

সিপিবি সভাপতি বলেন, নির্বাচনের পুরো সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবেন সে দল তত শতাংশ আসন পাবেন। টাকা, পেশিশক্তি, ম্যানিপুলেশন, কমিউনালিজম- এগুলো থেকে নির্বাচন ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে হবে। নমিনেশন কেনাবেচা বন্ধ করতে হবে। গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। নইলে দেশে ক্রমান্বয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত বাড়তেই থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, এবারও বিএনপি আন্দোলনে গেলে দেশ তো কিছু অস্থিতিশীল হবেই। নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে বিএনপির না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি রাজনীতিতে সংঘাতের নতুন শঙ্কা তৈরি করেছে। দলটি স্পষ্টতই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ফিরে গেছে। রাজপথে কর্মসূচি বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশের সঙ্গে, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়াচ্ছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য সার্চ কমিটি করে কোনো লাভ হবে না। সরকারের পছন্দের তালিকাভুক্ত লোক দিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে।

কে এম নূরুল হুদা কমিশন আইনের সঠিক প্রয়োগ করে নাগরিক অধিকার সুরক্ষা ও ভালো নির্বাচন করতে পারতো, যা বাস্তবে হয়নি। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!