• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আর্জেন্টিনার পথে পথে কান্নার রোল


ক্রীড়া ডেস্ক নভেম্বর ২৭, ২০২০, ১০:৩২ এএম
আর্জেন্টিনার পথে পথে কান্নার রোল

ঢাকা : ফুটবল ‘ঈশ্বর’ যেখানে যেতেন সেখানেই তাকে ঘিরে রাখত ভালোবাসার জনসমুদ্র। তিনিও ভালোবাসার জবাব দিতেন হাসিমুখে হাত নেড়ে। কিন্তু এসব স্মৃতি-স্তুতি এখন কাঁদিয়ে মারছে সারা দুনিয়াকে। চির ছুটিতে চলে গেছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার (২৬ নভেম্বর) থেকে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের প্রেসিডেন্টস প্যালেসে রাখা হয়েছে সাদা-আকাশি রঙের পতাকায় মোড়ানো কফিন। ফুটবলের ম্যারোডানাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন শোকে কাতর আর্জেন্টাইনরা।

আর্জেন্টিনায় চলছে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। গতকাল ম্যারাডোনার কফিনে প্রথমে শ্রদ্ধা জানায় পরিবারের সদস্যরা। পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ ও ফার্স্টলেডি ফ্যাবিওলা ইয়ানেজ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর শ্রদ্ধা জানাতে নামে শোকবিহ্বল জনতার ঢল।

রাষ্ট্রীয় শোক শেষে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় (বাংলাদেশ সময় আজ শুক্রবার সকাল) দেশটির রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের উপকণ্ঠে বেইয়া ভিস্তা কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে তার মরদেহ সমাহিত করার কথা রয়েছে। তবে তা স্থানীয় সময় পরদিন সকালেও পারে।

গতকাল প্রেসিডেন্টস প্যালেসে রাখা ম্যারোডানার কফিনের সামনে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন ১৯৮২ বিশ্বকাপ দলের সতীর্থ ৬৮ বছর বয়সী ওসভালদো আর্দিলেস। তিনি বলেন, ‘সে আমাদের জন্য ঈশ্বর। আমাদের আর্জেন্টাইনদের জীবনের বড় একটা অংশ। অবশ্যই সে স্পেশাল। তাকে ছাড়া আমাদের জীবন এখন কঠিন হয়ে উঠবে। সে অসাধারণ। তাকে যখন আপনি খেলতে দেখবেন বুঝবেন যে পুরো ব্যতিক্রম কিছু দেখছেন, যা আপনি কল্পনাও করেননি। তাকে যখন জাতীয় দলে প্রথম দেখি তখন থেকেই বুঝে যাই আমরা সবাই ভালো হলেও সে আমাদের চেয়ে মাইল ব্যবধানে এগিয়ে।’

কেমন ছিলেন ম্যারাডোনা সেই স্মৃতিচারণও করলেন আর্দিলেস। ‘আমি ওকে চিনি। সে সমাজের গরিবদের সব সময় সাহায্য করত। মাঠের বাইরে তার সমস্যা অনেক ছিল। তার রাজনীতির সঙ্গে, প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে ও রাজাদের সঙ্গে সমস্যা ছিল। সে এমন লোকদের খুব ভালো চোখে দেখত না। কিন্তু মাঠে নামামাত্রই সে ভিন্ন মানুষ হয়ে যেত। বুঝত যে এখানে সে-ই সেরা। তাকে কেউ ছুঁতে পারবে না। তাই উৎফুল্ল হৃদয় নিয়ে সে ফুটবল খেলত।’

হয়তো এই প্রথমবার সাধারণ জনগণ ম্যারাডোনার খুব কাছে আসছেন। একে একে, লাইন ধরে। একটু দূর থেকেই অবলোকন করছেন ম্যারাডোনার ক্যাসকেট। কিন্তু মুখ দেখার সুযোগ নেই, ডালা বন্ধ। তাই কিছু দূর থেকেই মহানায়কের প্রতি শেষ শুভেচ্ছা জানিয়ে সেই লাইন ধরেই বিদায় নিচ্ছেন সবাই। আর তখন সবার চোখেই অশ্রু।

কেউ চুমু ছুড়ে দিচ্ছেন, কেউ প্রার্থনা করছেন, কেউ জার্সি এনেছেন, কেউ এনেছেন ফুল। যার যা পছন্দ তা নিয়ে এসেছেন ম্যারাডোনাকে উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। দেশটির অন্যান্য শহর কর্ডোবা, রোসারিও, লা প্লাতা, সীমান্ত শহর সান হুয়ান, পোসাদাস এবং সুদূর পুয়ের্তো থেকেও ম্যারাডোনা প্রেমিকরা উপস্থিত।

আর্জেন্টিনাকে ফুটবল দিয়ে বিশ্বে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সোনার ছেলেকে বিদায় জানাতে বুয়েনস আয়ার্সের বোকা জুনিয়র্স স্টেডিয়ামে আলো জ্বালানো হয়। আর্জেন্টিনা কিংবদন্তির জার্সি নম্বর অনুযায়ী ঠিক রাত ১০টায় জ্বলে ওঠে লা বোম্বোনেরা স্টেডিয়ামের সব ফ্লাডলাইট। মাঠটি আর্জেন্টাইন ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের। এই ক্লাবের হয়েও খেলেছেন ম্যারাডোনা।

হাজারো ভক্ত ভিড় করেছেন ম্যারাডোনার প্রথম ক্লাব আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সের স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে। এ ক্লাবটির স্টেডিয়াম আরও আগেই ম্যারাডোনার নামে নামকরণ হয়েছে। ১৬৭ ম্যাচ খেলেছেন এই দলের হয়ে। ম্যারাডোনা স্টেডিয়ামের বাইরে আলোর প্রজ্বালন, ফুল, ছবি, জার্সি দিয়ে ফুটবল ঈশ্বরকে স্মরণ করেছেন ভক্তরা। একইভাবে তার জন্মস্থান ভিয়া ফিয়োরিতোর পুরো শহরটাই ভরে উঠেছে শুভাকাক্সক্ষীতে। এছাড়া লা প্লাতা জিমেনেশিয়া ক্লাবের চলমান কোচ ছিলেন ম্যারাডোনা। সেই ক্লাবটির স্টেডিয়ামেও এখন একই অবস্থা।

তিন দিনের যে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে, আর্জেন্টিনা সরকার ধারণা করছে এই সময়ে কোটি লোক প্রেসিডেন্টস ভবনে আসবেন। এই বিশাল জনসমাগম সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। সময়ে সময়ে বিশৃঙ্খলাও হচ্ছে। রাজধানীর সমাগম কেন্দ্র প্লাজা ডি মেয়োতেও ভিড় সেই বুধবার রাত থেকেই।

শোকস্তব্ধ নাপোলিও, স্টেডিয়াম ম্যারাডোনার নামে করার ঘোষণা : আর্জেন্টিনা থেকে সুদূর ইতালির নেপলস শহরও শোকে স্তব্ধ। নেপলসের জন্য ম্যারাডোনা ছিলেন ফুটবল ঈশ্বর। তাকে আর্জেন্টাইনদের মতো নেপলসবাসীও হৃদয়ে বহন করেন। নেপলস শহর জুড়েই দেয়ালে দেয়ালে ম্যারাডোনার ম্যুরাল আঁকা আছে। নব্বই দশকেই প্রিয় ফুটবলার স্মরণে এই অঙ্কন করেছিলেন নেপলসবাসী। সেই সব ম্যুরাল এখন আলোয় আলোকিত। মোমবাতির আলো, জার্সির সম্ভার, রঙিন কাগজে ছেয়ে আছে নাপোলির প্রায় সব গলি।

ম্যারাডোনার বিদায়ে তাকে স্মরণীয় করে রাখতে ভিন্ন উপায় বের করেছে নাপোলি ক্লাব। দলটির স্টেডিয়াম সান পাওলোকেই ম্যারাডোনার নামে করার কথা উঠেছে। সাত বছর এই ক্লাবে খেলা আইকনকে এভাবেই সম্মান জানাতে চায় ইতালির ক্লাবটি।

ক্লাব প্রেসিডেন্ট অরেলিও ডি লরেন্তিস এক বিবৃতিতে জানান, ‘আমার মনে হয় সান পাওলোর নাম বদলে ম্যারাডোনার নামে করার এটাই সঠিক সময়। এভাবে ম্যারাডোনা ও পুরো বিশ্বকে জানাতে চাই তাকে আমরা আমাদের সঙ্গেই রেখেছি। ম্যারাডোনা, তুমি নাপোলিটানসদের হৃদয়ের আনন্দ। এই ক্লাব তোমাকে এখনো সুন্দর পথে স্মরণ করতে চায়, যে পথে তুমি আমাদের নিয়েছিলে। ধন্যবাদ ডিয়েগো, তুমি আমাদের সঙ্গেই আছ।’    

বিশ্বের নানা প্রান্তে, নানা দেশেও আর্জেন্টাইন ফুটবল অনুরাগীরা শোকাতুর। অনেক শহরেই ম্যারাডোনার পোস্টার, তার ছবি ছাপানো পতাকা নিয়ে ভক্ত-সমর্থকরা ফুটবল ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সারা বিশ্বের পত্রপত্রিকার প্রথম পাতায় ডিয়েগো ম্যারাডোনার ছবি। ফ্রান্সে লা ইকুইপ দৈনিকের শিরোনামটি সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী‘ঈশ্বর মৃত’।

মৃত্যু হয়েছে ঘুমের মধ্যে : ম্যারাডোনার মৃত্যুর নানা আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে ময়নাতদন্ত হয়ে গেছে তার। স্থানীয় সময় ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।  প্রাথমিকভাবে যেটা জানানো হয়েছিল, সেটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। হৃদরোগেই মৃত্যু হয়েছে ম্যারাডোনার। এটাও জানা গেছে যে, ঘুমের মধ্যেই মারা গেছেন ফুটবল জাদুকর।

সান ইসিদ্রো অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে জানানো হয়েছে, গত পরশু স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে ১১টায় ম্যারাডোনাকে তার বিছানায় পাওয়া যায়। চিকিৎসক বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তাকে জাগাতে।

২০০০ সাল থেকেই নাকি হৃদরোগে ভুগছেন ম্যারাডোনা, আর গুরুতর রূপ নেওয়া এই শারীরিক সমস্যাই তার অন্তিম যাত্রার কারণ হলো।

মৃত্যুর আগে শেষ কথা ভাতিজার সঙ্গে : জীবনের খেলা শেষ করে চলে গেছেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’ ম্যারাডোনা। বেশ কিছুদিন ধরেই শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না এই ফুটবল কিংবদন্তির। বুধবার মৃত্যুর দিনও শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করেন তিনি। ভাতিজাকে সে কথা বলেছিলেন। তার সঙ্গেই ম্যারাডোনার শেষ কথা হয়।

ডেইলি মেইল জানায়, ম্যারাডোনার ভাতিজা বলেছেনসকালে ম্যারাডোনা যখন নাশতা করতে আসেন, তখন তাকে ফ্যাকাশে লাগছিল। তিনি বলছিলেন, তার ঠাণ্ডা লাগছে। অসুস্থতার কথা জানানোর পরই বিছানায় চলে যান তিনি।

এরপর একজন নার্স ম্যারাডোনাকে দেখেন। তিনি চিকিৎসককে ফোন করেন। তবে চিকিৎসক পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়।

বাবা-মায়ের পাশে দ্রুত সমাহিত করার ভাবনা পরিবারের : প্রেসিডেন্সিয়াল ভবনে কফিনে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনা সরকারের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবারের পক্ষ থেকে ম্যারাডোনার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দ্রুত শেষ করার কথা ভাবা হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে অবশ্য এ বিষয়ে এখনো কিছু বলা হয়নি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!