• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষীণদৃষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২১, ১২:১১ পিএম
ক্ষীণদৃষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা

ঢাকা : করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকায় বাচ্চাদের হাতে উঠেছে মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ, নোটবুক। যারা আগে এসব ডিভাইস থেকে দূরে ছিল তারাও হয়েছে আসক্ত। খেলার সময়, খাওয়ার আগে, অনলাইন ক্লাস, ঘুমের সময় ক্ষণে ক্ষণে চাই মোবাইল। আর এতে করে শিশুদের মাঝে ‘মায়োপিয়া’ বা চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিজনিত রোগ বাড়ছে।

মায়োপিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে কী পরিমাণ এমন রোগী রয়েছে তার পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগের পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। গেল দুই বছরে এই হাসপাতাল থেকে সেবা নেওয়া মায়োপিয়া রোগী বেড়েছে ১০ শতাংশ।

হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, করোনার আগে এই হাসপাতালে সেবা নেয়া রোগীর ২২ শতাংশ মাইয়োপিয়া আক্রান্ত রোগী পাওয়া যেতে। করোনা কারণে ঘরবন্দি থাকায় শিশুদের মধ্যে বেড়েছে এ রোগ। এখন বেড়ে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রায় দুই বছর শিশুরা ঘরবন্দি। কাজ না থাকায় সারাক্ষণ স্ক্রিনে; দূরের জিনিস দেখেনি। ফলে তাদের দূরের দৃষ্টিশক্তি ঠিকমতো তৈরিই হচ্ছে না। আট বছর পর্যন্ত শিশুদের চোখের গঠনগত পরিবর্তন হতে থাকে। এই বয়সের শিশুরা যদি দূরের জিনিস না দেখে তাহলে আস্তে আস্তে দূরের দৃষ্টিশক্তিই হারিয়ে ফেলবে। বড় হওয়ার পরেও তাদের এই সমস্যা কাটবে না।

এ বিষয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী জানান, করোনার কারণে মায়োপিয়া রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ স্বাভাবিক হওয়ার পর হাসপাতালে রোগী অনেকগুণ বেড়েছে।

তিনি বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে আমাদের হাসপাতালে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী দেখলেও এখন এই সংখ্যা বেড়ে ৩০০ খেকে ৪০০ হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৩ শতাংশই দূরে দেখার দৃষ্টিতে সমস্যা নিয়ে আসে। তার একটি বড় অংশ শিশুরা।’

খায়ের আহমেদ জানান, করোনার আগে ২০১৯ সাল ও ২০২০ সালে ২০ থেকে ২২ শতাংশ ছিল মায়োপিয়া। করোনার মধ্যে এ জাতীয় রোগীর হার বেড়েছে ১০ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ করোনা মধ্যে শিশুদের ডিভাইসে আসক্তি।

শিশুরা এখন অধিকাংশ সময় এখন অনলাইনে কাটায়। করোনা সংক্রমণের আগে বাচ্চারা বাবা-মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানের ঘুরতে যেতে পারত, এখন সেটাও করতে পারে না। ঘরবন্দি বাচ্চারা সময় কাটাতে মোবাইলকে বেছে নিচ্ছে। ঘুমের সময় ছাড়া বাকি সময় কাটছে মোবাইলের মাধ্যমে।

রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী আরিশা। বয়স ১১ বছর। চোখের ক্ষীণদৃষ্টিজনিত রোগের কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে গেল তিন বছর ধরে চশমা ব্যবহার করছেন। ছয় মাস পর পর চশমার পাওয়ার পরিবর্তন করা লাগে। সবশেষ জুনে চশমার পাওয়ার পরিবর্তন করা হয়েছে।

আরিশার মা ফামিদা তারিন জানান, এটা জন্মগত কোনো সমস্যা নয়। পড়াশোনা ও অধিক সময় মোবাইল ব্যবহারের কারণে কমে এসেছে দূরের দৃষ্টিশক্তি। করোনার কারণে মোবাইল নির্ভরতা আরো অনেক বেড়েছে। করোনার মধ্যে রুটিনের বাইরে চলে গেছে মোবাইল ব্যবহারের পরিমাণ।

ফামিদা বলেন, মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা ও চোখ ব্যথায় ভোগে আরিশা। এখন রাতে ঘুমায় দেরি করে, সকালে ওঠে দেরি করে। উঠেই মোবাইল খোঁজে। কিছু বললে বলে মোবাইলে পড়ালেখা করবে। আর আমরা সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকায় মনিটরিংও করতে পারছি না।’ আরিশার মতো হাজার শিশু এখন এই সমস্যায় ভুগছে।

করোনার কারণে এতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে। শিশুদের মোবাইল, ল্যাপটপ জাতীয় ডিভাইস থেকে ফেরাতে তাদের হাতে তুলে দেয়া যেতে পারে গল্পের বই। সেইসঙ্গে শিশুদের সঙ্গে বাবা-মায়েরা গল্প করতে পারে। পরিবারের সবাই মিলে মিলে মাঝে মাঝে আড্ডার ব্যবস্থা করতে পারে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে এই সমস্যা কাটিয়ে তোলা যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের পরামর্শ, শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস নিলে যেন বিরতি নেয়। ৩০ মিনিট পর পর গ্যাপ দিলে বেশি ভালো হয়।

এ সমস্যা কাটাতে আরো কিছু পরামর্শ দিয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কথা বলেছেন তারা। শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে। শহর এলাকার বাচ্চাদের বেশির ভাগ ফাস্ট ফুডের ওপর নির্ভরশীল। এই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে।

ডিভাইসগুলো অবশ্যই সীমিত পরিসরে ব্যবহার করতে হবে। অল্প আলোতে লেখাপড়া যাতে না করে সেটাও লক্ষ্যে রাখতে হবে। বাড়ির কাজ করলে বিরতি দিয়ে দিয়ে করতে হবে। গল্পের বই একটানা যেন দীর্ঘ সময় ধরে না পড়ে। এক্ষেত্রে শুধু অভিভাবকরা নয়, চিকিৎসক ও শিক্ষকদেরও ভূমিকা রাখতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞানের বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাজনীন খান বলেন, চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিজনিত সমস্যা দূর করতে কোনোভাবে যেন একনাগাড়ে কম্পিউটারের সামনে বা কোনো ডিভাইসের সামনে না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

তার ভাষ্য, শিশুদের চোখের সমস্যা স্থায়ী হয়ে যাওয়ার কারণ সঠিক সময়ে তাদের চোখ বা দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করা হয় না। শিশুদের দৃষ্টিশক্তি কম থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে যতক্ষণ তারা কথা না বলে বোঝাতে পারছে ততক্ষণ তাদের অভিভাবকরা বুঝতেই পারেন না তার শিশুর চোখের দৃষ্টিশক্তি কত।

ঘরে থাকা শিশু বারবার মোবাইল বা টেলিভিশন দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, বারবার চোখের পাতা বন্ধ করে খুলতে থাকলে মাওপিয়া আক্রান্ত হতে পারে। মাঝে মাঝে মাথা ও চোখব্যথা হতে পারে।

অনেক সময় দৃষ্টিত্রুটির কারণে চোখ বাঁকা হতে পারে। আবার চোখ বাঁকা হওয়ার কারণে দৃষ্টিতে ত্রুটি হতে পারে। কিছু পড়তে গেলে শিশু চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করছে কি না, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। লক্ষণগুলো দেখা দিলে অভিভাবকদের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, এখন আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। আক্রান্ত শিশুরা যখন স্কুলে গিয়ে ক্লাস করবে, তাদের ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা দেখতে অসুবিধা হবে।  তারা (আক্রান্ত শিশু) ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা খাতাতে তুলতে পারে না। এ কারণে পাশের বাচ্চা থেকে লেখা কপি করে।

এ রোগের প্রধান কারণ মোবাইল ফোন অথবা অন্য কোনো ডিভাইসের প্রতি নির্ভরতা। কম্পিউটার বা মোবাইল থেকে এক ধরনের নীল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে। নিয়মিত দীর্ঘসময় ধরে নীল উজ্জ্বল আলো চোখের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যা দীর্ঘমেয়াদে অঙ্গটির ক্ষতি করে। করোনাভাইরাসের কারণে এ সমস্যা বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ রোগ থেকে বাঁচতে অভিভাবকদের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমরা যারা চক্ষু বিশেষজ্ঞ, তাদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, একই সঙ্গে এখানে অন্য চিকিৎসক ও অভিভাবকদের তেমন ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে শিশু চিকিৎসকরা। শিশুদের কোনো সমস্যা দেখা দিলে অভিভাবকরা দ্রুত তাদের কাছে নিয়ে আসেন। তারা অন্যান্য পরীক্ষার সঙ্গে চোখের পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন।  এসব সমস্যা দেখা দিলে হয়তো চশমা দিয়ে সমাধান করা যাবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতায় এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!