• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাসুমার স্বপ্নযাত্রা


 অরণ্য সৌরভ আগস্ট ৯, ২০২১, ০৭:৫৩ পিএম
মাসুমার স্বপ্নযাত্রা

ঢাকা : স্কুল-কলেজে পাঠকালীন উচ্চতা কম হওয়ায় ক্লাস ক্যাপ্টেন বা অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করার সুযোগ পাননি তিনি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও এলাকায় ছিল না তেমন কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। 

কিন্তু মনের কোণে জমিয়ে রাখা স্বপ্ন, দেশের তরে কাজ করার ইচ্ছাকে তো আর মিথ্যার ব্যর্থমালা পরানো যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পা রাখার পরই খুলে যায় স্বপ্নপূরণের দরজা-জানালা। 

সামাজিক ও যুব উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় ‘ন্যাশনাল ইয়ুথ আইকন অ্যাওয়ার্ড ২০১৯’, ‘গ্লোবাল চেঞ্জমেকার অ্যাওয়ার্ড-২০২০’, ‘আউটস্ট্যান্ডিং লিডারশিপ এজ এ ফ্রন্ট লাইন ফাইটার ডিউরিং কোভিড-১৯’ সম্মাননাসহ সম্প্রতি ‘কালাম ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ জমা হয়েছে তার সাফল্যের ঝুড়িতে। 

চারপাশ নিস্তব্ধ। কোথাও সুখের কোলাহল নেই। উৎসবে উচ্ছ্বসিত নয় কেউ। দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক তরুণ-যুবই অবসর যাপন করছেন। তবে রয়েছে এর ব্যতিক্রমও। মহামারীর এই সময়টাতেই তিনি অন্যান্য সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় পার করছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সংগঠনের অনেক কাজের সাথে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করে রেখেছেন। এখন তার একটুও ফুসরত নেই। যেন সবসময় কাজের মধ্যেই আছেন। তিনি সেরা মায়ের সেরা মেয়েও। ক্যাম্পাসের বন্ধুরা ‘মাসুমা’ বা ‘মাসু’ বলে ডাকলেও তার পুরো নাম মাসুমা মরিয়ম। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ থেকে স্নাতক শেষ করে বর্তমানে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত।

বগুড়ার শেরপুরের সাধুবাড়ী গ্রামে দুরন্ত শৈশব কাটলেও বাবা-মায়ের চাকরির সুবাধে শেরপুর শহরে বেড়ে ওঠা। প্রভাষক বাবা মোহাম্মাদ আলী  ও গ্লোবাল টিচার্স প্রাইজ ২০১৭-র বিশ্বের সেরা ৫০ শিক্ষকের একজন, মা শাহনাজ পারভীনের বড় সন্তান তিনি।

স্কুল-কলেজে পাঠকালীন উচ্চতা কম হওয়ায় ক্লাস ক্যাপ্টেন বা অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করার সুযোগ পাননি তিনি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও এলাকায় ছিল না তেমন কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ায় অভিভাবক ও শিক্ষকরা সবসময় পড়াশোনার তাগাদাই দিতেন। কিন্তু মনের কোণে জমিয়ে রাখা স্বপ্ন, দেশের তরে কাজ করার ইচ্ছাকে তো আর মিথ্যার ব্যর্থমালা পরানো যায় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পা রাখার পরপরই খুলে যায় স্বপ্ন পূরণের দরজা-জানালা। বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রার শুরুতেই যুক্ত হয়ে যান কয়েকটি সংগঠনের সাথে। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে কাজের সুবাধে তিনি উপলব্ধি করেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা কাজের ক্ষেত্রে যুবরা তেমন মূল্যায়িত হচ্ছেন না। আবার অনেক সময় শুধু ঢাকার যুবদের কাজ করার সুযোগ থাকছে। সেই উপলব্ধি থেকেই কোন ধরনের বৈষ্যম্যের শিকার না হয়ে যুবরা যেন নির্দ্বিধায় কাজ করতে পারেন তেমন একটি প্ল্যাটফরম তৈরির পরিকল্পনা করেন। আর ছেলেবেলা থেকেই পিছিয়ে পড়া যুবদের নিয়ে কাজ করার বাসনা তো রয়েছেই। যুবদের সংকট, সম্ভাবনাসহ নানান বিষয়ের আলোকেই মূলত যুবদের তরে কাজ করার স্বপ্ন যাত্রা তার।

শৈশব থেকেই দেখে এসেছেন পরিবারের প্রায় সকলেই বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত। সেই সুবাধেই মায়ের প্রচেষ্টা আর বাবার সহযোগিতায় ২০১৫ সালে স্থানীয়ভাবে বগুড়ার শেরপুরের যুবদের জন্যে কাজ করার বাসনা থেকেই ‘স্বপ্ন ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশান’র যাত্রা শুরু করেন। ধীরে ধীরে বিভিন্ন কাজ চালিয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে ২০১৮ সালে সংগঠনটি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের নিবন্ধিত একটি সংগঠন হয়ে ওঠে। এরপর থেকে যুবদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ ও ক্যাম্পেইনের আয়োজনের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে স্থানীয় যুবদের সুযোগ সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। সারা দেশে তাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে ২০১৯ সালে প্রথম বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সংগঠনে যুক্ত করেন। বর্তমানে ৭ জন কার্যকরী সদস্য এবং ২০ জন সাধারণ সদস্যের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬২ জন স্বেচ্ছাসেবী ও ২৬ জন ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর নিয়ে কাজ করছে মাসুমার স্বপ্ন ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট সংগঠনটি।

সংগঠনটি যুবদের দক্ষ ও স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ, পাখি ও পশুপালন প্রশিক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ণ বিষয়ক ওয়ার্কশপ, কম্পিউটার প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ট্রেইনিং ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করেন।

সংগঠনটি এখন পর্যন্ত যে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তার মধ্যে অন্যতম-মহামারীর শুরুতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুলে করোনা সচেতনতামূলক ক্যাম্পিং, করোনার সময় যুবদের বিভিন্নভাবে কাজের সাথে যুক্ত রাখতে ফটোগ্রাফি কনটেস্ট, লেখালেখি প্রতিযোগিতা, পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, করোনার সময়ে ৩৪টি দেশের প্রায় ৭৫০ জন তরুণ-তরুণীদের এবং ৫টি দেশের ১০ জন অতিথি নিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট সামিট ২০২০’র আয়োজন করা, মহামারীর কঠিন সময়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থেকে রক্ষার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ক্যাম্পেইন ‘হাউ আর ইউ, রিয়েলি?’ এর আয়োজন করেন।

এছাড়া তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আয়োজন করা হয় মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ ‘সাইকোলজিক্যাল ফার্স্ট এইড ট্রেইনি’। তাছাড়া নারীদের ওপর অত্যাচার, ধর্ষণ প্রতিরোধে ‘রাইট টু ফাইট এগেইনস্ট হারেসমেন্ট’ ক্যাম্পিংয়ের আয়োজন করেন তারা।

এর বাইরে সংগঠনের ভলান্টিয়ারদের প্রতি মাসে গ্রাফিক্স ডিজাইন, ইমেইল কমিউনিকেশন, কমিউনিকেশন স্কিল ইত্যাদি যুগোপযোগী ট্রেনিং এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে স্কিল ট্রেক, ইয়ুথ স্কিল হ্যাকস ইত্যাদি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে যাচ্ছেন।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা ও নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিজের নামের পাশে দেশের পতাকা দেখার মতো প্রশান্তি আর হয় না।’

ছোটবেলায় ব্যারিস্টার বা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে অনেক কিছুই হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপক হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছেন। ভবিষ্যতে দুর্যোগ ও যুবদের জন্যে কাজ করার পাশাপাশি দেশের মানুষের জন্যে কাজ করতে চাওয়া এই তরুণীর সাফল্যের ঝুড়িটাও খুব ক্ষুদ্র নয়।

সামাজিক ও যুব উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য ‘ন্যাশনাল ইয়ুথ আইকন এওয়ার্ড ২০১৯’, ‘গ্লোবাল চেঞ্জমেকার অ্যাওয়ার্ড-২০২০’, ‘আউটস্ট্যান্ডিং লিডারশিপ এজ এ ফ্রন্ট লাইন ফাইটার ডিউরিং কোভিড-১৯’ সম্মাননা, ‘কালাম ইয়ুথ লিডারশিপ কনফারেন্স-২০২০’ এ সেরা বক্তা এবং সম্প্রতি ‘কালাম ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ তার সাফল্যের ঝুড়িতে জমা হয়েছে। এছাড়া জায়গা পেয়েছেন ‘ওয়ার্ল্ড ইয়াং পারসন অব দ্য ইয়ার ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত তালিকায়।

তবে তিনি মনে করেন সাফল্য একটা আপেক্ষিক জিনিস। তার বা তার সংগঠনের কাজ দেখে যদি কেউ অনুপ্রাণিত হয় কিংবা তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে সেটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। তিনি মনে করেন এখনো তার অনেকটা পথ হাঁটা, অনেক দূর যাওয়ার বাকি।

পুরস্কৃত হওয়ার সাথে সম্পর্কিত বিশেষ স্মৃতি সম্পর্কে মাসুমা বলেন, প্রতিবারই আন্তর্জাতিক কোনো পুরস্কার পাওয়ার সময় নিজের নামের সাথে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা শুনলেই অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। এই অনুভূতিকে কি বলে তা জানা নেই আমার। তবে সেই মুহূর্তের জন্য নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে হয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!