• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী অসুস্থ, ফেরি করে সংসার চালাচ্ছেন জীবনযোদ্ধা মুসলিমা


খুলনা প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১, ০২:৪২ পিএম
স্বামী অসুস্থ, ফেরি করে সংসার চালাচ্ছেন জীবনযোদ্ধা মুসলিমা

ঢাকা: পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির (স্বামী) আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে পথে নামতে হলো তসলিমা বেগম মুসলিমাকে (৪১)।

স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে ভালোই চলছিল খুলনার দৌলতপুর জুটমিলের শ্রমিক ওবায়দুর রহমানের (৫০) সংসার। সেই সুখে ছেদ পড়ে ২০১৯ সালে। হার্টের সমস্যার কারণে রিং পড়ানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা করানোর অর্থ ছিল না তার। ধীরে ধীরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। 

এদিকে জুট মিল বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে পড়েন ওবায়দুর। সংসারে দেখা দেয় অভাব-অনটন। তিন মেয়ের লেখাপড়ার খরচ তো দূরের কথা, ধার-দেনা করে তাদের খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল। এঅবস্থায় নিরুপায় হয়েই মুসলিমা শুরু করেন বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড় বিক্রির কাজ। শুরুতে হেঁটে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে থ্রি-পিসসহ নারীদের পোশাক বিক্রি করেন। তাতেও চলছিল না সংসার। পরে একটি বাইসাইকেল কেনেন। সেই সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুড়ি, ফিতা, গোল্ডপ্লেটের কানের দুল, আংটি, চেইন, টিপ, চিরুনিসহ প্রয়োজনীয় মালামাল বিক্রি শুরু করেন। 

মুসলিমার স্বামী ওবায়দুর রহমান বলেন, দুই বছর আগে থেকেই আমার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। ২০১৯ সালে মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তাম। এরপর খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসক দেখায়। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে। আমি হাটতে গেলে হাঁপিয়ে যেতাম, অনেক সময় বুকে ব্যথা অনুভব করতাম। হার্টের ৯০ শতাংশ ব্লক ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা দ্রুত এনজিওগ্রাম করে রিং পরানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে রিং পড়ানো সম্ভব হয়নি। 

তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় চিকিৎসাও নিতে পারছি না। জুটমিলও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছি। এ অবস্থায় সংসার চালাচ্ছেন আমার স্ত্রী। এখন ভারী কোনো কাজ করতেও পারি না। আর হৃদরোগে আক্রান্ত শুনলে কেউ কাজও দিতে চায় না। দুর্দশার মধ্যে আছি। তিন মেয়ের লেখাপড়াও ঠিকমতো করাতে পারছি না। যদি কোনো ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা করতে পারে তাহলে উপকৃত হতাম।

দেখা যায়, সাইকেলের সামনে ও পেছনে একাধিক ব্যাগ ও কাগজের কার্টনে মালামাল নিয়ে ফেরি করার উদ্দেশে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন মুসলিমা। খালিশপুর হাউজিং বাজারের এস লাইনে এক বাড়ির সামনে জটলা পাকিয়ে রয়েছেন কয়েকজন নারী। মাঝে মুসলিমা চুড়ি, টিপ, চিরুনিসহ গ্রাহকের চাহিদা মাফিক মালামাল খুলে দেখাচ্ছেন। অনেকে পছন্দের জিনিস কিনছেন, অনেকে আবার দর কষছেন। সামান্য লাভ হলেই জিনিস ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। কেউ কেউ নগদ টাকা দিয়ে পছন্দের জিনিস কিনছেন, কেউবা বাকিতে খাতায় লিখে রাখছেন। এভাবেই দৈনিক সাইকেলে বাড়ি বাড়ি ফেরি করে মালামাল বিক্রি করছেন মুসলিমা। জীবনযুদ্ধে এক সংগ্রামী নারী তিনি। এখন তিনি ওই এলাকার নারীদের প্রিয়জন।

খালিশপুর হাউজিং বাজার এস লাইনের গৃহবধূ শাহানারা বেগম বলেন, মুসলিমা ভাবীকে ২২ বছর ধরে চিনি। খুব ভালো তিনি। কিন্তু খুব কষ্ট তার। স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত। এখন বাধ্য হয়ে এলাকায় সাইকেলে মালামাল বিক্রি করার জন্য নেমেছেন। সরকার বা কোনো বিত্তবান যদি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে আমরাও খুশি হব।

জীবনযুদ্ধে হার না মানা সংগ্রামী নারী তসলিমা বেগম মুসলিমা বলেন, আমার স্বামীর হার্টে ৯০ শতাংশ ব্লক ধরা পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে তার চিকিৎসা করাবো কীভাবে? তারপরও আমি হাল ছাড়িনি। দৈনিক ফেরি করি, বাচ্চাদের পড়ালেখা ও খাবারের ব্যবস্থা করছি। স্বামীর চিকিৎসার টাকার ব্যবস্থা করছি।

তিনি আরও বলেন, প্রথমে আমি ব্যাগ কাঁধে করে নারীদের আনুষঙ্গিক জিনিস বিক্রি শুরু করি। এখন আর কাঁধে করতে পারি না। মেরুদণ্ডের হাড়ে সমস্যা হয়ে গেছে। এরপর সাইকেল কিনলাম। এখন কখনও সাইকেল চালিয়ে, কখনও হেঁটে হেঁটে জিনিস বিক্রি করি। দৈনিক ৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। খুব কষ্ট করেই চলছে। বিত্তবানরা যদি আমাদের পাশে দাঁড়াতেন তাহলে খুব উপকার হতো। 

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!