• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনিরাপদই রয়ে গেল ঢাকার সড়ক


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ৩০, ২০১৯, ০১:৫৫ পিএম
অনিরাপদই রয়ে গেল ঢাকার সড়ক

ঢাকা : ‘পরিবহন সেক্টরের মানুষরা অনেক পাওয়ারফুল। তাদের এত ক্ষমতার পেছনে কলকাঠি কে নাড়ে?’ -এমন প্রশ্ন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করা রুহুল আমিনের। তার এ প্রশ্নের উদ্রেক নিচের দৃশ্যটির মুখোমুখি হওয়ায়।

সোমবার (২৯ জুলাই) তিনি অফিস করতে মৌচাক-রামপুরা-বিশ্বরোড রোডের একটি গণপরিবহনের ভেতরে বসা ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তারই আরেক সহকর্মী রেজাউল বাবু।

এ সময় রাইদা পরিবহনের দুটি বাস রাজধানীর রামপুরা পার হয়ে বিশ্বরোডের দিকে যাচ্ছিল। একটি অপরটিকে পেছনে ফেলার প্রতিযোগিতায়ও ছিল। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে সড়কের মাঝ বরাবর থামে একটি বাস। পিছু পিছু আসা অন্যটি বাম পাশ দিয়ে আগে আসা বাসটির দরজার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায়। ফলে প্রথম বাস থেকে নামতে গিয়েও পারেন না কয়েকজন যাত্রী। দ্বিতীয় বাসটি যাত্রী উঠিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। প্রথম বাসটি মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়েই যাত্রী নামায় এবং দ্রুতগতিতে ছুটতে ছুটতে কাছের সুবিধাজনক স্থানে থামে। যদিও ওখানে তার থামার কথা নয়। এতেও ওই সড়ক ধরে চলাচল করা অন্য যানবাহনের গতি থেমে যায়।

এ সময় রুহুলের মতো অনেক যাত্রীকে আক্ষেপ করতে শোনা যায়, সড়কে কবে শৃঙ্খলা ফিরবে; আদৌ কি ফিরবে? তাদের এক বছর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই স্টাফ রোডের দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করতে দেখা যায়। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী- দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীব।

সোমবারের দুটি বাসের প্রতিযোগিতায় ঠিক এমনই আরেক দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারত। তখন নড়েচড়ে বসত সবাই। হতো আন্দোলন, ফের ঘুম। এমনই ক্ষোভ প্রকাশ করেন সোমবারের দুটি বাসের প্রতিযোগিতায় অতিষ্ঠ একাধিক যাত্রী।

তারা এ-ও স্মরণ করান, শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীব জীবন দিয়ে কিছুটা হলেও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়েছে। ওই সময়েই শুরু হয় ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’। রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলনের আঁচ। রাস্তায় নামেন লাখো শিক্ষার্থী।

তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি ওঠে। রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। গণপরিবহনসহ ব্যক্তিগত গাড়ির কাগজ পরীক্ষা করাসহ সব ধরনের যানবাহনকে নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। শুরুতে এ আন্দোলনে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও পরে যুক্ত হন সাধারণ জনগণ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভায় একটি খসড়া ট্রাফিক আইনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে কারো প্রাণহানি ঘটালে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।

আন্দোলনকারীদের ৯ দফা দাবির মধ্যে কয়েকটি পূরণ ও বাকিগুলো পূরণের আশ্বাসে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। শিক্ষার্থীরা ফিরে যান শ্রেণিকক্ষে। ৮ আগস্টের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

এদিকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও ২ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দৃশ্যমান পরিবর্তন খুব বেশি হয়নি বলে মত অনেকের।

বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) তথ্যানুযায়ী, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে ১ হাজার ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১ হাজার ৫৫২ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৩৯ জন আহত হন। জাতীয় মহাসড়ক, আন্তজেলা সড়ক ও আঞ্চলিক সড়কসহ সারা দেশে এসব দুর্ঘটনা ঘটে।

এ সংগঠনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চালকদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, দৈনিক চুক্তিতে চালক, কন্ডাক্টর বা হেলপারের কাছে গাড়ি ভাড়া দেওয়া, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, সড়কে চলাচলে পথচারীদের অসতর্কতাসহ ১০টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্যদিকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলাকালেই ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। চলে ৫ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত। সেপ্টেম্বরজুড়ে সচেতনতা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত পালন করা হয় ট্রাফিক সপ্তাহ।

এ বছর আবারো ট্রাফিক আইন বিষয়ে সচেতনতা ও আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে লাগাতার কর্মসূচি হাতে নেয় পুলিশ। ১৫ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পালন করা হয় ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ। ১৭ মার্চ থেকে শুরু হয় ট্রাফিকের বিশেষ অভিযান, চলে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এরই মধ্যে ২৪ মার্চ থেকে ঢাকায় নামে স্পেশাল টাস্কফোর্স। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে কাজ করে ১০ মে পর্যন্ত।

এই বিশেষ উদ্যোগ চলাকালে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্স ছাড়া ড্রাইভিং কিংবা নবায়ন না করা, হেলপারের গাড়ি চালানো, অর্থাৎ ট্রাফিক আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মোটরসাইকেলে ৩ জন চড়া, চালকের পাশাপাশি যাত্রীর হেলমেট ব্যবহার, সিগন্যাল না মানা, উল্টোপথে যাওয়া এবং প্রভাবশালীদের আইন না মানার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এতে কিছুটা শৃঙ্খলা আসে রাজধানীর সড়কে।

এসবের মধ্যে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের এক বছরে কিছুটা শৃঙ্খলা এসেছে। কিন্তু সেটা দৃশ্যমান নয়। পথচারী পারাপার, জেব্রা ক্রসিং, ফুট ওভারব্রিজ, আন্ডারপাসসহ এসব বিষয়ে সরকারের যে অঙ্গীকারগুলো ছিল, সেগুলো পূরণ হয়নি। কোনো কোনো জায়গায় উন্নয়ন কাজের জন্য কিছু ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ভেঙে ফেলা হয়েছে। এসব স্থাপনা ভেঙে ফেলা হলেও পথচারী চলাচলের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়নি।’

সড়কে গণপরিবহনের যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে আন্দোলন করা এই নেতা বলেন, ‘এই সমস্যা সমাধানে মালিকদের আন্তরিকতা দেখা যায় না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সবচেয়ে বড় অংশীদার গণপরিবহনের মালিক ও চালকরা। তাদের আন্তরিকতায় ঘাটতি আছে। তাদের যে ভূমিকা রাখার কথা, সেটা দেখা যায় না। আরো বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। সরকারের এ সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।’

সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘পথচারী ও চালকদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার জন্য আমরা গত এক বছরে অনেক কাজ করেছি। হেলমেট, দরজা বন্ধ করে গাড়ি চালানো, পরিবহন নেতা ও চালকদের নিয়ে সভা, তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমরা কাজ করেছি। সার্বিকভাবে আগের তুলনায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে দিন দিন জনসংখ্যা ও গাড়ি বাড়ছে। সে অনুযায়ী আমাদের কাজ করে যেতে হচ্ছে। নানা বাস্তবতা আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চালক ও পথচারীদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে আলোচনা করছি। তাদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। ট্রাফিক আইন মেনে চলতে মোটিভেশন দেওয়া হচ্ছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। ক্রমে অবস্থার উন্নতি হবে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আনিছুর রহমান বলেন, ‘রোড মার্কিং, বাস স্টপেজ, যাত্রী ছাউনি, জেব্রা ক্রসিং, অন স্ট্রিট পার্কিংসহ নানা ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় চক্রাকার বাস চালু হয়েছে। এ ছাড়া কিছু কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে সড়কে আরো উন্নতি হবে।’

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের জাতীয় ও সিটিভিত্তিক উদ্যোগ আছে। নিরাপদ সড়কের বিষয়টা একরকম, আর সড়কে শৃঙ্খলার বিষয়টা অন্যরকম। ঢাকায় রোড রেশনালাইজেশনের কাজ চলছে। এটা হলে ঢাকায় টোটাল শৃঙ্খলা আসবে। এই কাজ চলমান রয়েছে।’

যদিও এক বছরে ঢাকাসহ দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা বলি, আর সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন বলি, গত এক বছরে অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

এই যে একটা আন্দোলন হলো, তার পরিপ্রেক্ষিতে নানা নির্দেশনা এল; কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায় কিছুই হলো না, তার দায়টা কিন্তু সরকারের ওপরই বর্তায়। পাশাপাশি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদেরও কিন্তু একটা দায় থেকে যায়। কারণ সড়কের বড় স্টেকহোল্ডারদের একটা বড় অংশ তারা।

এর মাঝেই সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, গত এক বছরে ঢাকাসহ দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা অনেকটাই বদলে গেছে। এ ক্ষেত্রে তারা উদাহরণ হিসেবে মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী- উভয়েরই হেলমেট ব্যবহার করার উদাহরণ বেশি দিচ্ছেন। তার মধ্যেই ভুক্তভোগীরা বলছেন ঢাকার সড়ক শৃঙ্খলায় ফেরাতে এবং নিরাপদ করতে ট্রাফিক ও পরিবহনসংশ্লিষ্টদের সর্বাগ্রে ভালো হতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!