• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আদালত, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির নির্দেশ উপেক্ষিত

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই শহীদ মিনার


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯, ০৩:৩০ পিএম
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই শহীদ মিনার

ঢাকা : উচ্চ আদালতের নির্দেশ আছে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি নেওয়ার শর্তেও উল্লেখ আছে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে ক্যাম্পাস ও শহীদ মিনার নির্মাণের। শর্তপূরণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিভিন্ন সময় ‘তাগাদা’ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু শহীদ মিনার নির্মাণের শর্ত, আদেশ ও নির্দেশ সবই উপেক্ষা করছে দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শহীদ মিনার নির্মাণ না করেই চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। কয়েকটির বিরুদ্ধে শিক্ষা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ারও বিস্তর অভিযোগ আছে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কয়েক দশক ও যুগ পার হলেও সেগুলোতে আজো নির্মাণ হয়নি বায়ান্নর ভাষাশহীদদের স্মরণে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতর জবাবদিহি ও মন্ত্রণালয়ের কয়েক কর্মকর্তাকে নানাভাবে ম্যানেজ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পার পেয়ে যাচ্ছে বলেও ব্যাপক অভিযোগ আছে। একই সঙ্গে আদালত, মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির নির্দেশ অমান্যের অভিযোগও আছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা উপেক্ষিত। বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব এসব প্রতিষ্ঠানে এমনিতেই বেশি। তার ওপর মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ না থাকা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বায়ান্নর ঐতিহাসিক ঘটনাবলির স্মৃতি নিয়ে আবেগ ও অনুভবের অপূর্ব মিশেলে গড়া এ শহীদ মিনার। ভাষার অধিকার রক্ষার শপথ নিয়ে এ মিনার সাহস, সংগ্রাম ও প্রেরণার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো যেকোনো সঙ্কটে জাতি মিলিত হয় শহীদ মিনারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করেও শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনসহ জাতির নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতিচর্চা সম্পর্কে আদৌ জানতে পারছে কি না, এ প্রশ্নও শিক্ষাবিদদের।

তারা মনে করেন, নীতিমালা না মেনে বছরের পর বছর ধরে ভাড়া বাড়িতে কোনো রকমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে শহীদ মিনার নির্মাণের সুযোগও নেই। স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েক দফায় সময় বেঁধে দিলেও বেশিরভাগই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে বা ভাড়াবাড়িতে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে নীতিমালা মানতে বাধ্য করতে পারলে শহীদ মিনার নির্মাণসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব নিয়মের বাস্তবায়ন সম্ভব হতো বলে মত দেন তারা।

যোগাযোগ করলে ইউজিসির চেয়ারম্যান ড. আবদুল মান্নান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শহীদ মিনার নির্মাণ উপলব্ধির ব্যাপার। সরকারি না বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তা মুখ্য নয়। ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনার যেকোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি।’  শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘শহীদ মিনার না থাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হীনতা। এটা খুবই দুঃখজনক।’

তথ্যমতে, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করতে ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট আদেশ দেন উচ্চ আদালত। ওই নির্দেশ অনুযায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ বাধ্যতামূলক। তখন আদালত বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ ও সংরক্ষণ করতে হবে।’
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা এবং জাদুঘর স্থাপনের নির্দেশনা চেয়ে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই আদেশ দেন। এতে শহীদ মিনারের পাশে গ্রন্থাগারসহ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সমৃদ্ধ তথ্যপঞ্জিকা রাখা, ভাষাসংগ্রামীদের প্রকৃত তালিকা তৈরি ও প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ, মর্যাদা রক্ষাসহ আটটি নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আদালতের রায় অনুসারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ‘অবিলম্বে বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে’ সব আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলায় তখন চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। চিঠিতে বলা হয়, ‘আদালতের রায়ের আলোকে সরকার এ নির্দেশ দিয়েছে।’ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক দফা সময় নেয়।

অন্যদিকে কয়েক দফা সময় নিয়েও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আদালতের ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করায় ২০১২ সালে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। একই বছরে সংস্কৃতি ও পূর্ত সচিবকে তলব করেন উচ্চ আদালত। ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারা আদালতে হাজির হয়ে অভিযোগের ব্যাখ্যা দেন। তখন আদালত তাদেরকে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে গ্রন্থাগারসহ ভাষাশহীদ জাদুঘর স্থাপন, ভাষাসংগ্রামীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন ও শহীদ মিনার নির্মাণসহ রায় বাস্তবায়নে নির্দেশ দেন।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি এর ছয় বছর কেটে যাওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে, আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৭ সালের  ১৯ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালত এ বিষয়ে আবার আদেশ দেন। এতে বলা হয়, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এরপর প্রায় দেড় বছর চলে গেলেও নির্দেশনাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

বেসরকারি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়া ও জমিস্বল্পতার কারণে শহীদ মিনার নির্মাণ সম্ভব হয়নি। দেশে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কত, এ তথ্য ইউজিসির ওয়েবসাইটে থাকলেও এগুলোর মধ্যে কয়টিতে শহীদ মিনার আছে, কয়টিতে নেই, সে তথ্য নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে। অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনার না থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি এ বিষয়ে ‘ছাড়’ দিয়ে আসছে। ইউজিসি জানায়, স্থায়ী ক্যাম্পাসে গিয়েও কোনো প্রতিষ্ঠান শহীদ মিনার নির্মাণ না করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!