• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধ উপায়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার যুবকরা


মো. এমদাদ উল্যাহ সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯, ০১:১৫ পিএম
অবৈধ উপায়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার যুবকরা

ঢাকা : লোভে পড়ে অবৈধভাবে দালালদের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অসংখ্য যুবক। তারা পরিবার ও সমাজেও হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন। সারা দেশে প্রতারিত ওই যুবকদের স্বাবলম্বী করতে প্রশিক্ষণ ও অনুদান দিচ্ছে ব্র্যাকের প্রত্যাশা প্রকল্প। এ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনুদানপ্রাপ্তরা।

এর মধ্যে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ফুলের নাওড়ী গ্রামের গ্রিস ফেরত ইয়াছিনকে ১ লাখ টাকা ও নোয়াগ্রামের ইতালি ফেরত আবুল কালামকে ৮৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়। ব্র্যাকের অনুদানের টাকা ও নিজের জমানো টাকা দিয়ে দুজনেই স্থানীয় বাজারে ব্যবসা করছেন।

তারা বলেন, সব নিয়ম মেনেই বৈধ উপায়ে ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়া উচিত। অবৈধ উপায়ে প্রবাসে গেলে কোনো সমস্যায় পড়লে এর দায়ভার কেউ নিতে চায় না। লোভে না পড়ে নিজের জীবনের কথা বিবেচনা করে যুবকদের বিদেশে যাওয়ার অনুরোধও করেছেন তারা।

জানা গেছে, জীবিকা অর্জনের তাগিদে বিশ্বে জনসংখ্যার ৩.৪ ভাগ মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশেরও অসংখ্য যুবক আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে স্বাবলম্বী হচ্ছে।

শুধু ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৭ লাখ ৩৪ হাজার কর্মী বিদেশ গিয়েছিল। এদের মধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ১ হাজার ৬০৯ জন। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পেছনে অভিবাসন খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অভিবাসন প্রত্যাশীরা প্রতিনিয়ত প্রতারণার সম্মুখীন হচ্ছেন।

বিশেষ করে দক্ষতা অর্জন না করেই অবৈধ উপায়ে এবং দালালদের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকে। আবার দালালদের থেকে টাকা আদায় করতে না পেরে পরিশোধ করতে পারছেন না ঋণের টাকা। তাছাড়া সাগরপথে ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়ার পথে অনেকে মারা যাচ্ছে। চলতি বছরের ১১ মে শনিবার লিবিয়া থেকে স্বপ্নের দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতালিতে যাওয়ার পথে ভূ-মধ্যসাগরে নৌকা ডুবে সিলেটের ৬ জনসহ বেশ কয়েকজন মারা যায়।

এভাবে স্বপ্ন গড়তে গিয়ে সাগরপথে অসংখ্য যুবকের স্বপ্ন বিলীন হতে দেখা যায়। ইউরোপে বর্তমানে স্টুডেন্ট ভিসা ও ট্যুরিস্ট ভিসা চালু রয়েছে। আমাদের উচিত এগুলোকেও কাজে লাগানো।

সম্প্রতি দালালদের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ১০-১২ জন। আবার মধ্যপ্রাচ্য গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন সংখ্যা কয়েকগুণ।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রত্যাশা প্রকল্প জানাচ্ছে, লোভে না পড়ে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাজের শর্তে ভালোভাবে জেনে বুঝে, সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সব বৈধ কাগজপত্র নিয়ে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করা, যে দেশে যাবে সে দেশের ভাষা ও আইনকানুন সম্পর্কে জানা, জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে নিরাপদ অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য, যেমন— নাম নিবন্ধন, ভিসা চেক, আঙুলের ছাপ দেওয়া, ব্রিফিং সেশন ইত্যাদি নিশ্চিত ভাবে জানতে হবে। চাকরি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার আগে যে দেশে যাবেন সে দেশের চাকরির বাজার ও সুযোগ-সুবিধা যাচাই করে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বিদেশ যাওয়ার আগে পাসপোর্টে নিজের নাম, পিতার নাম, মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা ঠিক আছে কি-না; ভিসা ও চুক্তিপত্র সংক্রান্ত কাগজপত্র নিকটস্থ জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস এবং বিএমইটির মাধ্যমে যাচাইকরণ; অনুমোদিত মেডিকেল থেকে মেডিকেল টেস্ট করানো; বিদেশ যাওয়ার সময় পাসপোর্ট, টিকিট, স্মার্টকার্ড, বিএমইটি অফিসের ছাড়পত্র; এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরসহ সব গুরুত্বপূর্ণ কাগজ যাচাইপূর্বক হাতের কাছে রাখতে হবে।

অন্যদিকে বিদেশ থেকে প্রতারিত হয়ে ফেরত এলে কোনোভাবেই ভেঙে পড়া ঠিক হবে না। স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য নিজেকে গুটিয়ে না রেখে সবার সঙ্গে মন খুলে আলোচনা করা, কাছের মানুষের কাছে নিজের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে উদ্যোগ নেওয়া, প্রয়োজনে পেশাদার কাউন্সিলরের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। এতে করে হতাশা কাটিয়ে উঠে জীবনকে উপভোগ করা যাবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদেশ যাওয়ার পর বাংলাদেশি যুবকদের কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট দেশের আইন ও সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতে, বাংলাদেশ দূতাবাসের ঠিকানা ও ফোন নম্বর এবং নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র নিজের সংগ্রহে রাখার ব্যাপারে অনাগ্রহী। তারা মনে করে, কোনো রকম টাকা উপার্জন করতে পারলেই চলে। কেউ কেউ অবৈধ উপায়ে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রেও বেআইনি কাজ করে থাকে। এসব প্রবাসীই অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন।

আবার দেখা গেছে, বিদেশে যেতে গিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি বা ব্যক্তির দ্বারা প্রতারিত হওয়া, চুক্তিপত্রের শর্তানুযায়ী কম বেতন বা অনিয়মিত বেতন প্রদান, বেতন ছাড়া অতিরিক্ত কাজ করাতে চাইলে ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশে কাজ করাতে বাধ্য করলে ও কর্মস্থলে নির্যাতন করলে, যৌন হয়রানি বা অবৈধ কোনো কাজ করতে বাধ্য করলে কোথায় অভিযোগ করতে হবে এমন তথ্য জানে না অনেকেই।

যারা অভিযোগ করতে জানেন, তাদের অনেকেই নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে করা চাকরির চুক্তিপত্র, ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে দেওয়া টাকার রসিদ, পাসপোর্ট কপি ও ট্রাভেল পাস সঠিকভাবে দেখাতে পারেন না।

অথচ বিদেশে অবস্থানরত সংশ্লিষ্ট দেশের শ্রম আদালত, দূতাবাস বা বিএমইটিতে অনলাইনে ও ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডে অভিযোগ করা যাবে। এ ছাড়া প্রতারিত হয়ে দেশে ফেরার পর জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, জেলা প্রশাসকের দপ্তর, প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, স্থানীয় থানা, মানবাধিকার সংস্থা, এনজিওতে অভিযোগ করা যাবে।

প্রতিবছরই প্রতারণার শিকার হয়ে প্রবাস থেকে অনেক মানুষ দেশে ফেরত আসে। তাদের বিষয়টি একেবারে উপেক্ষিত থেকে যায়। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম সারা দেশে বিদেশ ফেরতদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।

মূলত অভিবাসন সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং ইউরোপ ফেরতদের পুনরেকত্রীকরণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রমে ব্র্যাকের প্রত্যাশা প্রকল্প কাজ করে থাকে। বিদেশ যেতে ইচ্ছুক যুবকরা যাতে প্রতারণার শিকার না হয়, সেজন্য সচেতনতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন হাটবাজার ও জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ভিডিও প্রদর্শনী, গণনাটক প্রদর্শন ও টি স্টল মিটিং করা হয়।

এছাড়া প্রতারিত হওয়া যুবকদের স্বাবলম্বী হতে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজন মতো নগদ অর্থ অনুদান দেওয়া হয়। সুতরাং লোভে না পড়ে সম্পূর্ণ বৈধ উপায়ে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যুবকদের আরো সচেতন হতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক
[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!