• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অরক্ষিত শাহজালাল বিমানবন্দর


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ১১, ২০১৯, ১২:৪০ পিএম
অরক্ষিত শাহজালাল বিমানবন্দর

ঢাকা : অরক্ষিত হয়ে পড়েছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার শত শত লোক থাকলেও নিরাপত্তার কোনো বালাই নেই। প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৪ কিলোমিটারেরও বেশি প্রশস্ত বিরাট আয়তনের এ বিমানবন্দরের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে অন্তত ৭টি গোপন রাস্তা বানানো হয়েছে। দেয়াল ভেঙে তৈরি করা হয়েছে আরো ৫-৬টি বড় আকারের ছিদ্র, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ফোকলা’।

সম্প্রতি পলাশ নামে এক তরুণ যাত্রী উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের অস্ত্র ও গুলিসহ বিনা বাধায় নিরাপত্তা সীমানা অতিক্রম করার পর বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দুর্বলতা ও অরক্ষিত হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। এ নিয়ে গত ক’দিন ধরেই বিভিন্ন মহলে চলছে নানা গুঞ্জন।

সূত্র জানায়, দুবাইগামী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ (বোয়িং-৭৩৭) ছিনতাই চেষ্টার ঘটনার কারণ এখনো স্পষ্ট হয়নি। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির জন্য নির্দিষ্ট পাঁচ কার্যদিবসের চেয়ে আরো দুদিন সময় বাড়ানো হলেও এখনো প্রতিবেদন দিতে পারেনি। অন্যদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হেভি লাগেজ স্ক্যানিং মেশিনে দায়িত্বে থাকা ফজলার রহমানের স্ক্যানিং মেশিন চালানোর প্রশিক্ষণ নেই বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি ফজলারকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছে।

এ ছাড়া বিমান ছিনতাই চেষ্টার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে কর্তব্যরত নিরাপত্তাপ্রহরী ইউনুস হাওলাদার, এরিয়া সুপারভাইজার লেহাজ উদ্দিন ভূঁইয়া, আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্য আলীম, সালাম ও মাহফুজকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। একই ঘটনায় পোস্ট সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্বে থাকা বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে বিমানবাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুবাইগামী একটি উড়োজাহাজ (বিজি-১৪৭) ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন যাত্রী পলাশ আহমেদ। ওই সময় অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী ইউনুস হাওলাদার এবং লেহাজ উদ্দিন। তাদের দায়িত্ব পালনকালে ওই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে।

তদন্তের স্বার্থে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মচারী চাকরি প্রবিধিমালা অনুযায়ী নিরাপত্তা সুপারভাইজার মো. লেহাজ উদ্দিন ভূঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সাময়িক বরখাস্ত থাকা অবস্থায় তিনি সদর দফতর প্রশাসন বিভাগে হাজিরা দেবেন এবং বিধি মোতাবেক খোরাকি ভাতা প্রাপ্য হবেন।

তবে সিভিল অ্যাভিয়েশন সূত্র এ প্রসঙ্গে জানায়, ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে বেলা ২টা ৪১ মিনিটে যখন বিমান ছিনতাই চেষ্টার সঙ্গে জড়িত যাত্রী পলাশ আহমেদ হেভি লাগেজ স্ক্যানার-১ পার হন এবং ২টা ৫৬ মিনিটে এন্টি হাইজাকিং পয়েন্ট পার হন, তখন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এয়ারপোর্ট এরিয়া সুপারভাইজার (ডমেস্টিক) মো. লেহাজ উদ্দিন ভিভিআইপি টার্মিনালে প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে ৯ জন সদস্য নিয়ে নিরাপত্তা ডিউটিতে ছিলেন।

অন্যদিকে, ঘটনার হেভি লাগেজ স্ক্যানিং মেশিনের দায়িত্বরত ফজলার রহমানের স্ক্যানিং মেশিন চালানোর প্রশিক্ষণ না থাকার সত্যতা পেয়েছে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি। ফজলারকে জিজ্ঞাসাবাদে তারা এমন তথ্য পেয়েছে। ফজলারের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ঘটনার সময় স্ক্যানারের মূল দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল নিরাপত্তরক্ষী মিজানুর রহমানের। কিন্তু ফজলারকে সাসপেন্ড করা হলেও মিজানুর এখনো বহাল রয়েছেন।

শাহজালাল বিমানবন্দরের উপপরিচালক বেনীমাধব চৌধুরী বলেন, সিকিউরিটি গার্ড ফজলার রহমান স্ক্যানিং মেশিনের দায়িত্বে ছিলেন, তার স্ক্যানিং মেশিন চালানোর মতো কোনো ট্রেনিংই নেই।

এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে যাওয়ার উদ্দেশে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন যখন অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের প্রধান গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন, প্রথমেই তিনি হেভি লাগেজ স্ক্যানার-১-এর তল্লাশিতে পড়েন। এ সময় সেখানে দায়িত্বে ছিলেন এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি গার্ড ফজলার রহমান। যদিও ওই সময় তার দায়িত্ব ছিল মূল গেটে। স্ক্যানিংয়ের দায়িত্বে থাকা মিজানুর রহমান তাকে বসিয়ে রেখে চলে যান।

তিনি ১০-১২ মিনিট পর যখন ফিরে আসেন ততক্ষণে অস্ত্র-গুলির ব্যাগ স্ক্যান শেষে ভেতরে চলে যান ইলিয়াস কাঞ্চন। যদিও এ ঘটনার প্রসঙ্গে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ইলিয়াস কাঞ্চন অসত্য কথা বলছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব নেওয়ার আগে বারবারই ফজলার রহমান ডোমেস্টিকের ইনচার্জকে বলেছিলেন, ‘স্যার আমি কিন্তু স্ক্যানার অপারেটর না। আমি স্ক্যানার অপারেটর হিসেবে ট্রেনিং নিয়েছিলাম, কিন্তু পাস করতে পারিনি। এ কারণে আমাকে এয়ারপোর্টের বিভিন্ন গেটে টিকেট ও বডি চেকের দায়িত্ব দেওয়া হতো।’ এমন স্বীকারোক্তি সিভিল অ্যাভিয়েশন সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতেও দিয়েছেন ফজলার রহমান।

স্ক্যানিং মেশিন সম্পর্কে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি মুহূর্তে স্ক্যানার মেশিনে যাত্রীদের ২ থেকে ১০টা পর্যন্ত ব্যাগ ঢুকছে। অভিজ্ঞ না হলে কোন ব্যাগে কী যাচ্ছে সেটি মনিটরে ধরা সম্ভব নয়।

এ ছাড়া কনকর্স হলের বাইরে সীমানা দেয়ালের নিচ দিয়েও মাটি খুঁড়ে বানানো গোপন সুড়ঙ্গপথের মতো আরো কয়েকটি গর্ত রয়েছে। শুধু তাই নয়, রানওয়ের পানি অপসারণের জন্য নির্মিত কালভার্টের ভেতর দিয়েও অনেককে অনায়াসে রানওয়েঘেঁষা স্থান পর্যন্ত আসা-যাওয়া করতে দেখা গেছে। গোপন সুড়ঙ্গপথ দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে কিছু যুবককে ভেতরে ঢুকে আড্ডা ও ছাগল-ভেড়া চড়াতে দেখা গেলেও এদের মধ্যে কোনো দুষ্কৃতকারী বা কোনো সন্দেহভাজন গ্রুপের আসা-যাওয়া আছে কি না তা বলা মুশকিল।

সীমানা দেয়াল ভেঙে অবৈধভাবে গড়ে তোলা প্রবেশপথেও ফোকলাপথ প্রসঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এক পদস্থ কর্মকর্তা জানান, প্রাচীর ভাঙা, মেরামত, কাঁটাতারের বেষ্টনী নির্মাণের যাবতীয় দায়িত্ব সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির।

বারবার নিরাপত্তা বিঘ্নকারী এসব গোপন প্রবেশপথ ও ফোকলার বিষয়ে লিখিতভাবে জানানো সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে এসব দেয়াল মেরামত বা পুনর্নির্মাণ করে না। এমনকি ওই গোপন পথগুলোর আশপাশে নিরাপত্তা বাতিও লাগানো হয় না। ফলে সন্ধ্যার পর থেকেই ঝোপঝাড়বেষ্টিত ওইসব এলাকায় ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। এ সুযোগ নিয়ে জঙ্গি বা দুষ্কৃতকারীরা সহজেই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!