আইসিজের সিদ্ধান্ত ২৩ জানুয়ারি

ঢাকা : রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার করা মামলায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না  সে সম্পর্কে আগামী ২৩ জানুয়ারি সিদ্ধান্ত দেবে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)। গাম্বিয়ার বিচার মন্ত্রণালয় সোমবার (১৪ জানুয়ারি) এক টুইটে এ কথা জানায়। খবর বিবিসির।

মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত রায় দিলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো পদক্ষেপ আসতে পারে। তাতে মিয়ানমার বিশ্বে ভাবমূর্তি সংকট এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।  ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের ১৫ বিচারকের সঙ্গে প্যানেলে গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মনোনীত দুই বিচারকও আছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।

২০১৭ সালের আগস্টের শেষের দিকে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে বর্বরতা হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করার অভিযোগে মিয়ানমারকে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে এনেছে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসে গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এ মামলার ওপর শুনানি হয়। তাতে গাম্বিয়ার পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির বিচারবিষয়কমন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। অন্যদিকে ছিলেন  মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি। আবুবকর তামবাদু শুনানিতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং গণহত্যা বন্ধের দাবি জানান।

নৃশংসতার জন্য দায়ী সেনা সদস্যদের বিচার ও সহিংসতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখা যায় না মন্তব্য করে মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা চেয়েছেন গাম্বিয়ার প্রধান কৌঁসুলি পল রিখলার। অন্যদিকে গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে সু চি দাবি করেন, রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে গাম্বিয়া যে চিত্র আদালতে উপস্থাপন করেছে তা অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। মিয়ানমারের সামরিক বিচার কাঠামোকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত মন্তব্য করে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা বাতিল করার আর্জি জানান তিনি।

দুপক্ষের যুক্তিতর্ক শোনার পর আইসিজের ১৭ সদস্যের বিচারক প্যানেল এ বিষয়ে আদেশের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। গত ১৩ ডিসেম্বর আইসিজের বিচারক প্যানেলের প্রধান আবদুলকাভি আহমেদ ইউসুফ বলেন, যত দ্রুত সম্ভব এ মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন তারা। গণহারে হত্যা, ধর্ষণ এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করাই যে রাখাইনে সেনা অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল, তা পরের বছর জাতিসংঘের স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে।

সেনাবাহিনীর ওই সাঁড়াশি অভিযানে অন্তত ১০ হাজার মানুষ নিহত হয় বলে ধারণা করা হয়। আর প্রাণ বাঁচাতে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়,  রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে তার মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে তা গণহত্যার অভিপ্রায়কে অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য।

সু চির বেসামরিক সরকার বিদ্বেষমূলক প্রচারকে উসকে দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংস করেছে এবং সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার সরকারও নৃশংসতায় ভূমিকা রেখেছে। শুনানিতে সু চি বলেন, রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে কি না সে বিচারের এখতিয়ার আইসিজের নেই। সেনা সদস্য বা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়মভঙ্গের অভিযোগ থাকলে মিয়ানমার তা তদন্তের পর দায়ীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করে থাকে।

তার ভাষ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ওই ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকলেও সেগুলো গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে না এবং ১৯৪৮ সালের কনভেনশনের অধীনে তার বিচার করা যায় না।  আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা এ মামলায় গণহত্যা প্রতিরোধ ও এর শাস্তি বিধানে ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষরিত কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। ১৯৫৬ সালে ওই জেনোসাইড কনভেনশনে সই করেছিল মিয়ানমার। গাম্বিয়াও এ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ।

কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো শুধু গণহত্যা থেকে বিরতই থাকবে না, এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ এবং এমন অপরাধের জন্য শাস্তি বিধান করতেও অঙ্গীকারবদ্ধ। আইসিজেতে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ তুলতে পারে। এ আদালত কোনো ব্যক্তিবিশেষকে সাজা দিতে পারে না, যেমনটি পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। তবে আইসিসি আলাদাভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার ঘটনা তদন্ত করছে।

আইসিজেতে মামলা হলে আদালতের সিদ্ধান্ত মানার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে সদস্য দেশগুলোর ওপর। সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। মানতে বাধ্য করার কোনো ক্ষমতা নেই এ আদালতের। তবে সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করারও বহু উদাহরণ রয়েছে। গাম্বিয়া রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার যে আর্জি জানিয়েছে, সেখানে গণহত্যার আলামত সংরক্ষণের বিষয়েও আদেশ চাওয়া হয়েছে।

মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়েছে কি না সে বিষয়ে রায় দিতে হলে আদালতে এটা প্রমাণ হতে হবে যে, রাষ্ট্রটি রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করেছে। সেটা যদি প্রমাণও হয় তবুও সু চি কিংবা মিয়ানমারের জেনারেলদের গ্রেপ্তার করা কিংবা তাদের বিচার করার মতো পদক্ষেপ নিতে পারবে না আইসিজে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই