• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আক্ষেপ কেবল ‘মঞ্জুর হত্যা মামলা’ রায়


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ১৫, ২০১৯, ১২:৫১ পিএম
আক্ষেপ কেবল ‘মঞ্জুর হত্যা মামলা’ রায়

ঢাকা : মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে চিরবিদায় নিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মামলার রায় নিয়ে আক্ষেপ ছিল সাবেক এই সামরিক শাসকের।

রোববার (১৪ জুলাই) রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান দেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদের এই সামরিক শাসক।

বিভিন্ন সময় এরশাদ জানিয়েছেন, জীবনের শেষে ২৯টি বছরে একটি দিনও তিনি ভালো ছিলেন না, সুখী ছিলেন না। গত বছর এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেন, এখনো আমার নামে মামলা আছে। আমার মতো দুঃখী কেউ নেই। পার্টির জন্য আমার চেয়ে বেশি কষ্ট কেউ করেনি।

দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ৪৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে মঞ্জুর হত্যা মামলা ছাড়াও জনতা টাওয়ার কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, স্বর্ণ চোরাচালান, টেলিকম দুর্নীতি, পোল্ট্রি ফার্ম দুর্নীতি, আয়কর ফাঁকি, জাহাজ কেনায় দুর্নীতি, রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, হরিপুরে তেল অনুসন্ধানে দুর্নীতি এবং রাডার কেনায় দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে এসব মামলা হয়। এর অনেকগুলোতে তিনি সাজা ভোগ করেছেন। কোনোটাতে খালাস পেয়েছেন। তবে রায়ের অপেক্ষায় ছিল মঞ্জুর হত্যা মামলা।

প্রায় ৩৮ বছর আগে সেনাবাহিনীর তৎকালীন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর হত্যা মামলা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এরশাদের গলার কাঁটা হয়েই ছিল। এরশাদের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলাম রোববার (১৪ জুলাই) জানান, এরশাদের বিরুদ্ধে শুধু একটি মামলাই নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল। বাকি ৪২টি মামলার নিষ্পত্তি আগেই হয়ে গেছে।

জানা যায়, ১৯৮১ সালের ৩০ মে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় চট্টগ্রামে একদল সৈন্যের গুলিতে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ওই সময় ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ছিলেন মঞ্জুর। ওই ঘটনার পর পুলিশের হাতে আটক হন এই সামরিক কর্মকর্তা।

পুলিশ হেফাজত থেকে দুই দিন পর ১ জুন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নেওয়ার পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন এরশাদ ছিলেন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে। পরে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন।

এরপর গণআন্দোলনে এরশাদের পতন ঘটলে ঘটনার ১৪ বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন মঞ্জুরের ভাই। ওই বছরই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তখনকার সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ অভিযোগপত্র দেন এবং বিচার শুরু করেন আদালত। তবে সরকার বদল এবং রাষ্ট্রপক্ষের গড়িমসিতে এ মামলার বিচারকাজ বিলম্বিত হতে থাকে বারবার।

এরশাদের দল জাতীয় পার্টি ও এরশাদের অভিযোগ, মামলাগুলো রাজনৈতিক কারণে পরিচালিত হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৭ জুন নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক শরীফ এ এম রেজা জাকের অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৬ আগস্ট দিন ঠিক করে দেন। তার আগেই মামলার প্রধান আসামি মারা গেলেন।

মামলার শুনানির সময় আত্মপক্ষ সমর্থনে এরশাদ বিভিন্ন সময় দাবি করেন, জেনারেল মঞ্জুরকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন সরকার রেডিও টিভিতে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তবে ওই ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। ধরা পড়ার পর চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আনার পথে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং পরে নিরাপত্তা প্রহরীর সঙ্গে গুলি বিনিময় হয়। একপর্যায়ে মঞ্জু গুলিবদ্ধ হলে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান।

২০১২ সালের ২ অক্টোবর নাজিমউদ্দিন রোডের বিশেষ এজলাসে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন এরশাদ।

২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি মামলার ২৩তম বিচারক ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হোসনে আরা আক্তার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য ওই বছর ১০ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করে দেন। কিন্তু এক সপ্তাহের মাথায় বিচারকের বদলির আদেশ আসে। তার জায়গায় নতুন বিচারক হিসেবে যোগ দেন খন্দকার হাসান মাহমুদ ফিরোজ। রায় দেওয়ার আগে তিনি নতুন করে যুক্তিতর্ক শুনতে চান। সেজন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করে দেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সেদিন এ মামলায় অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন। এরপর দফায় দফায় সময় বাড়ানো হলেও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন আর জমা দিতে পারেনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন, বাকি সব মামলা থেকে এরশাদ রেহাই পেলেও একটি মামলা এরশাদকে দুর্বল করে রেখেছিল। জোট আর ভোটের রাজনীতিতে এরশাদকে ‘বশে রাখতে’ এ মামলাটিকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি এরশাদের পতনের পর বিভিন্ন অভিযোগে মোট ৪৩টি মামলা হয়। এর তিনটিতে নিম্ন আদালতে তার সাজার আদেশ হলেও হাইকোর্টে একটিতে খালাস পান তিনি। বাকি দুই মামলায় তিনি সাজ ভোগ করেন এবং সাজা শেষ করেন।

রাষ্ট্রপতি থাকার সময়কালে পাওয়া উপহার সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আর্থিক অনিয়মের মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। দুই যুগ পর হাইকোর্ট সেই সাজা বাতিল করে এরশাদকে খালাস দেন।

জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালত এরশাদকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন। ১৭ বছর পর হাইকোর্ট সাজার মেয়াদ কমিয়ে এরশাদকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন। একই সঙ্গে ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করা হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলাকালে এরশাদের সাড়ে ৩ বছর কারাভোগ শেষ হওয়ায় আপিল বিভাগ পরে জরিমানার দণ্ড বহাল রেখে এরশাদকে অবশিষ্ট দেড় বছর সাজাভোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।

জাপানি নৌযান কেনায় অনিয়মের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় প্রথমে এরশাদের তিন বছর এবং পরে হাইকোর্টে আপিলে সাজা কমে দুই বছরের কারাদন্ড হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই বছর কারাগারে কাটানোয় এরশাদকে নতুন করে আর ওই মামলায় দণ্ড ভোগ করতে হয়নি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!