• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আগামী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ গুণগত উন্নয়ন


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ১, ২০১৯, ০৮:১৪ পিএম
আগামী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ গুণগত উন্নয়ন

ঢাকা : ১০ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতের উন্নতি ছাড়িয়ে গেছে অতীতের যেকোনো সময়ের রেকর্ড। এ সময়ে জাতীয় বাজেটের আকার উন্নীত হয়েছে তিন গুণে। ৬ শতাংশের বাধা পেরিয়ে মোট দেশজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি উঠেছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে। রফতানি আয়, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ, বাংলাদেশ ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ, শিক্ষার হার, গড় আয়ুসহ বিভিন্ন আর্থিক ও সামাজিক সূচকে উন্নতি হয়েছে অভাবনীয়। সংখ্যার বিচারে এসব খাতে উন্নতি হলেও মানের বিচারে অনেকটাই পিছিয়ে আছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের আগামী মেয়াদে এসব খাতে উন্নতি ধরে রাখার পাশাপাশি গুণগত মান নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, ব্যাংক খাতে সুশাসনের ঘাটতি আগামী সরকারের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবকাঠামো খাতে নেওয়া মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নে ধীরগতির বিষয়টিও টেনে ধরতে পারে উন্নয়নের চাকা। এক বছরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পাওয়া ৪০১ প্রকল্পের কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি আরো কমে আসবে। অনেক প্রকল্পে অর্থায়নও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। তা ছাড়া ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গতি না আসলে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে বলে মনে করেন তারা।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়ে থাকে, উন্নতির মহাসড়কে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত রসদ এখন পর্যন্ত হাতে নেই। বর্তমান ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোতে দেশের অর্থনীতি আর এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। আরো সামনে নিয়ে যেতে হলে অর্থনীতির পুরো কাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। গুরুত্ব বাড়াতে হবে সার্বিক সুশাসনে। নতুন প্রকল্প প্রণয়ন না করে চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।

সরকারের উন্নয়ন অগ্রাধিকার ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারের ১০ বড় প্রকল্পের মধ্যে একমাত্র পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ কিছুটা এগিয়ে আছে। ২০০৯ সালে অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্পের কাজ ২০১৫ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে কাজ হয়েছে ৬১ শতাংশ। প্রকল্পটির বাড়তি মেয়াদ গতকাল শেষ হয়েছে। ২০১৬ সালে নেওয়া পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হলেও এক দফায় বাড়িয়ে তা ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। বরাদ্দের ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে এর ভৌত কাজ হয়েছে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ অর্থ এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অগ্রগতি সাড়ে ৭ শতাংশ। রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ হয়েছে ১৬ শতাংশ। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, দোহাজারী থেকে রামু কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল, বিমানবন্দর-গাজীপুর র্যাপিড বাস ট্রান্সপোর্ট বা বিআরটি প্রকল্পেও প্রত্যাশিত গতি নেই। এসব প্রকল্পের কাজে গতি আসলে দেশের অর্থনীতির চালচিত্র অনেকটাই বদলে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের অভীষ্ট লক্ষ্যের সঙ্গে বড় প্রকল্প নির্বাচনের মিল আছে। তবে বাস্তবায়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না। প্রকল্পে ধীরগতির কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল পেতে বাড়তি সময় লাগছে। তিনি আরো বলেন, প্রকল্পের ডিজাইন, অনুমোদন ভালোভাবে হয় না। শুরুর পরেই বড় ধরনের সংশোধন করতে হয়। ঠিকাদাররা এ সুযোগটা নেয়।

বড় প্রকল্পে ধীরগতির মধ্যেই গত এক বছরে একনেকের ৩০ সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে আরো ৪০১ প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। অথচ চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ টাকা। এক বছরের এডিপির কয়েক গুণ বেশি ব্যয়ের প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ায় অর্থায়নে বড় ধরনের ঘাটতির আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে অনেকটা খড়গের মতোই ঝুলছে ভ্যাট আইনের সংশোধনী। এ আইন কার্যকর হলে পণ্যের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তা ছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা তরল জ্বালানি থেকে উৎপাদন করা প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সরকারের কাছে বিক্রি করছেন ২১ টাকা ৩ পয়সা। গ্রাহকপর্যায়ে একই বিদ্যুতের দাম রাখা হচ্ছে পাঁচ টাকার মধ্যে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) অনুমোদন দিলেও ভোটের আগে তা কার্যকর করা হয়নি। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি ভ্যাট আইনের সংশোধনী কার্যকর হলে ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়বে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গ্রহকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এমন সিদ্ধান্ত নির্বাচনের আগে কার্যকর হয়নি। এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে গ্রাহকদের ওপর বাড়তি বিলের বোঝা চেপে বসবে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেবে ব্যবসায়ীরা। ভোক্তার স্বার্থ মাথায় রেখে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

দেশের শিল্প খাত বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় আগামীতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথ অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। এর ফলে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে দেশের জনশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশকে বেকার হিসেবে চিহ্নিত করলেও খণ্ডকালীন নিয়োজিত ও শ্রমবাজারের বাইরের জনশক্তি যোগ করলে এর সংখ্যা ৪ কোটি ৯৬ লাখ ৯০ হাজার। বেকারত্বের মিছিলের অধিকাংশ সদস্যই শিক্ষিত ও তরুণ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম প্রতি ১০০ মানুষের ওপর নির্ভরশীল সাড়ে ৫৯ জন। এর মধ্যে শূন্য থেকে ১৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ২২ লাখ ৮৫ হাজার। আগামী কয়েক বছরে এদের একটা বড় অংশ কর্মবাজারে আসবে। অথচ দেশে মোট বেকারের বড় অংশই তরুণ জনগোষ্ঠীর। কোনো ধরনের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা কর্মের বাইরে আছেন ১ কোটি ২৩ লাখ তরুণ। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৪ কোটি ১৩ লাখ তরুণের মধ্যে শ্রমবাজারে আছেন ২ কোটি ১ লাখ। শ্রমবাজারের বাইরে আছেন ২ কোটি ১২ লাখ। আর তাদের মধ্যে বেকার আছেন ২১ লাখ ৩১ হাজার। মোট বেকারের ৭৯ দশমিক ৬০ শতাংশই তরুণ। শ্রমবাজারের বাইরে থাকাদের যোগ করলে তরুণ বেকারের সংখ্যা ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩১ হাজারে।

তরুণদের কর্মসংস্থান আগামী সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ অপরিহার্য। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না। অবকাঠামো খাতেও ঘাটতি রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান করে আগামীতে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে। দেশে প্রচুর দক্ষ কর্মীর চাহিদার বিপরীতে অদক্ষ শ্রমিকের জোগান থাকায় বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আনতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, সড়ক অবকাঠামো খাতে উন্নতি হলে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়বে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!