• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো কী?


আরণ্যক রিদোয়ান ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৯, ০২:৪৯ পিএম
আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো কী?

ঢাকা: হুমায়ুন আহমেদের ‘আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি’ বইটি পড়েছিলাম অনেক দিন আগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগা বইগুলোর একটি। ছোট্ট একটি ঘটনা উল্লেখ করি বই থেকে।

বইটির প্রধান চরিত্র ছিল একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত লোক। কৌশলে সে তার ছোট শ্যালিকার মাথায় ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করার ব্যাপারটি ঢুকিয়ে দেয়। সে জানত, মেয়েটির মাথায় এই ছাদ থেকে লাফ দেয়ার ব্যাপারটি থাকলে কোনো না কোনো একটি সময় মানসিক চাপ বাড়লে ঠিকই সে মুক্তির পথ হিসেবে ছাদ থেকেই লাফ দেবে।

এই যে একটি আত্মহত্যা হওয়ার পরেই আমরা কেউ সান্ত্বনা দিই, কেউ ধর্মীয়ভাবে মহাপাপ বলে আমাদের দায়িত্ব শেষ করি। অথচ এর পরদিন ঠিকই আরেকটি আত্মহত্যা ঘটেছে। আমরা-আমাদের সমাজ কিন্তু সবাই মিলে সেই মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকটির মতোই আচরণ করি।

সামাজিক জীবন-ক্যারিয়ার সব কিছু মিলিয়ে হাজারও মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। ক্লাস ফাইভ থেকে হাজারও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, প্রেমে ব্যর্থতা, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার এবিউজিংয়ের শিকার হওয়া, ধর্ষণ, হাজারটা সমস্যা। আর কালচারের বিভিন্ন উপাদানে প্রতিনিয়ত দেখানো হয় মানসিক চাপ থেকে মুক্তির উপায়-আত্মহত্যা।

নাটক-সিনেমা-সাহিত্যে বহুকাল আগে থেকেই আত্মহত্যাকে একটি নায়কোচিত কাজ হিসেবে দেখানো হয়। সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি আত্মহত্যা করার পেছনের কারণকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, কোনো পাঠকের কাছে মনে হবে তার পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।

একটি ব্যাপার লক্ষ্য করুন, সেই নাটক-সিনেমা-সংবাদ যারা দেখছেন-পড়ছেন, তাদের বেশিরভাগই কোনো না কোনো মানসিক চাপে আছেন।

নাটক-সিনেমা-বই-সংবাদপত্র সব জায়গায় যখন সে দেখতে পায় তার মতোই পরিস্থিতিতে এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন, তখন তার মাথায়ও নিজের অজান্তেই ব্যাপারটি গেথে যায়। আর কোনো সমাধান না খুঁজে সবচেয়ে সহজ-সবচেয়ে প্রচলিত সমাধানটিকেই সে বেছে নেয়। ফল- আরেকটি আত্মহত্যা, আরেকটি গল্পের নায়ক, আরেকটি সংবাদের শিরোনাম।

একটি আত্মহত্যার পর ‘আর কোনো উপায় ছিল না তাই আত্মহত্যা করেছে’, ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’, ‘আহারে’ এসবের কোনোটাই পরবর্তী আত্মহত্যা রোধ করতে পারবে না।

সময় এসেছে আত্মহত্যার পরে সহমর্মিতার চেয়ে আত্মহত্যার আগেই সহযোগীতার মাধ্যমে সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা।

আত্মহত্যার কয়েকটি কেস যদি কেউ বিশ্লেষণ করেন, দেখবেন- প্রায় সবক্ষেত্রেই আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো ঘুরেফিরে একই। খারাপ রেজাল্ট, প্রেমে ব্যর্থতা, ইভটিজিং, ধর্ষণ...।

আপনার ছেলেমেয়ে-বন্ধু-ছোটভাই যখন এ ধরনের কোনো না কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, তার দিকে নজর দিন। তার মানসিক অবস্থা কেমন আছে তা খেয়াল করুন। কেউ একদিনেই আত্মহত্যা করে না। অনেক অনেক দিনের চাপা মানসিক কষ্টই একদিন আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।

যদি বুঝতে পারেন আপনার প্রিয়জন দীর্ঘদিন কোনো মানসিক চাপে আছে। কারণ জানতে চেষ্টা করুন। যে সমস্যার কারণে সে মানসিক চাপে আছে তার কোনো সমাধান আছে কিনা তা খুঁজে বের করুন। যদি মনে করেন আপনার-পরিবারের চেষ্টা সত্ত্বেও তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না, তা হলে অবশ্যই একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। আত্মহত্যা প্রবণতা চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি মানসিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর যথোপযুক্ত চিকিৎসাও বিদ্যমান।

বাংলাদেশে আমার জানা মতে, ‘কান পেতে রই’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা হেল্পলাইন রয়েছে। তা ছাড়া বয়সন্ধিকালীন মানসিক-শারীরিক সমস্যার জন্য বাংলাদেশ সরকারের একটি হেল্পলাইন আছে (09612600600)।

জরুরি প্রয়োজনে আপনি এ ধরনের কোনো সংস্থা থেকেও প্রাথমিক সাহায্য পেতে পারেন। নিজের কিংবা প্রিয়জনের সমস্যার কথা খুলে বলতে পারবেন।

ওপরের পদক্ষেপগুলো হচ্ছে ব্যক্তিপর্যায়ের। কিন্তু প্রধান সমস্যাটি যে সিস্টেম ও কালচারের, সেই সিস্টেম-কালচার পরিবর্তন না হলে এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান সম্ভব নয়।

ক্লাস ফাইভ থেকে শুরু বোর্ড পরীক্ষার নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করা উচিত। যতদিন বন্ধ না হয়, আত্মীয়স্বজন-অভিভাবকদের উচিত এই মানসিকভাবে অপরিপক্ক শিশুদের রেজাল্ট জানার নামে হয়রানি বন্ধ করা।

গল্প-উপন্যাস-সিনেমাতে 'প্রেম, সত্যিকারের ভালোবাসা' নামক হাওয়াই উপাদানগুলোর উপস্থিতি কমানো। মানতে কষ্ট হলেও এটিই সত্যি যে, এই বাস্তবতা বিবর্জিত উপাদানগুলোর বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখে না। আত্মহত্যার প্রধান কারণের একটি অবশ্যই এই প্রেমে ব্যর্থতা।

ইভটিজিং-নারী নির্যাতন-ধর্ষণের বিরুদ্ধে এখন দেশে কঠোর আইন বিদ্যমান, দরকার সে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন। সামাজিকভাবে একজন নির্যাতিতার পুনর্বাসনে দরকার সমাজের প্রত্যেকের সহযোগিতা।

এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে এসে পড়ে এসব আইনের অপব্যবহার রোধের বিষয়টি। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সময়ের প্রয়োজনে তৈরি হওয়া আইন বর্তমানে অপব্যবহার হচ্ছে অহরহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খালিদ স্যারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আমরা সাধারণ মানুষ সমস্যার গভীরে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। দেশের বিশিষ্ট সমাজের উচিত এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ আপনারা এগিয়ে আসুন। সমস্যার মূল কোথায় খুঁজে বের করুন। সমাধানের উপায় বের করুন। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে ব্যবস্থা নিন।

আমরা কেউই চাই না শাবিপ্রবির মো. সাইফুর রহমান প্রতীক কিংবা চিটাগাং মেডিকেলে কলেজের ডা. মোস্তফা মোর্শেদ আকাশের মতো আর কোনো প্রিয়জন আত্মহত্যা করে আমাদের থেকে হারিয়ে যাক।

তাই আসুন আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতন হই। প্রিয়জনের জীবন বাঁচাই।

লেখক: আরণ্যক রিদোয়ান, শিক্ষার্থী, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!