• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘আমজাদ হোসেনের সাফল্য আমাদের বিস্ময় বিমোহিত করেছে’


ছটকু আহমেদ ডিসেম্বর ১৫, ২০১৮, ১১:২৮ এএম
‘আমজাদ হোসেনের সাফল্য আমাদের বিস্ময় বিমোহিত করেছে’

আমজাদ হোসেন ছটকু আহমেদ

ঢাকা: চলচ্চিত্রে এমন কোন বিষয় নেই যেখানে চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের বিচরণ নেই। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনিকার, গীতিকার, সংলাপ লেখক, চিত্রনাট্যকার এবং একজন সফল অভিনেতা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার অসাধারণ সাফল্য আমাদেরকে বিস্ময়ে বিমোহিত করেছে।

কিছুদিন আগে বিএফডিসিতে পরিচালক সমিতির বারান্দায় (ভেতরে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল) আমজাদ ভাইয়ের সাথে বসে আলাপ হচ্ছিল। আমজাদ ভাইয়ের সাথে আলাপ মানেই চলচ্চিত্রের এক বিশাল অতীতের স্মৃতি ভান্ডার খুলে বসা। কবে কোথায় কোন চলচ্চিত্র কীভাবে শুরু হয়েছিল, অতীতের চলচ্চিত্রের পরিবেশ কিরকম ছিল, প্রোডাকশন বয় থেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা পর্যন্ত সবার কিরূপ একনিষ্ঠ ইনভলবমেন্ট ছিল, কাহিনি, সংলাপ চিত্রনাট্য রচনায় কিরকম মুন্সিয়ানা ছিল ইত্যাদি দিনের আলোর মতো উঠে আসত সেই বৈঠকি আলাপে। শুনতে শুনতে আমজাদ ভাইয়ের হাত ধরে চলে যেতাম চলচ্চিত্রের এক ঐতিহ্যমান অতীতে। স্বপ্নের মতো বিচরণ করতাম সেই সব চলচ্চিত্রের সোনালি দিনগুলিতে। আমজাদ হোসেন এক কথায় চলচ্চিত্রের একটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র।

ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, শিশু সাহিত্যিক আমজাদ হোসেন ১৯৪২ সালে ১৪ আগস্ট জামালপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। লেখালেখির মাধ্যমেই তার সৃজনশীল জীবন শুরু। ছড়া লিখে সাহিত্য অঙ্গনে তার প্রবেশ। তার প্রথম কবিতা ছাপা হয় কলকাতার বিখ্যাত দেশ ম্যাগাজিনে। ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন বহু গল্প ছড়া এবং উপন্যাস। আমজাদ হোসেন ১৯৬১ সালে ‘তোমার আমার’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে যুক্ত হোন। এরপর তার কাহিনি ও সংলাপ নিয়ে প্রখ্যাত পরিচালক সালাউদ্দিন নির্মাণ করেন ‘ধারাপাত’। বলা যায়, এটি বাজিমাত। ‘ধারাপাত’ চলচ্চিত্রে এক নতুন দিগন্তের শুরু করে। এখনো তার সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘একটু আগুন দিবি-’ মনে দাগ কেটে যায়।

তারপর একে একে অনেক ছবিতে সহকারী পরিচালক, কাহিনিকার, সংলাপ লেখক, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে আমজাদ হোসেন কাজ করেন। ১৯৬৭ সালে ‘জুলেখা’, ১৯৬৮ সালে ‘বাল্যবন্ধু’, ১৯৭০ ‘পিতা পুত্র’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ১৯৭৩ সালে ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ১৯৭৬ সালে ‘নয়নমনি’, ১৯৭৮ সালে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ১৯৭৯ সালে ‘সুন্দরী’, ১৯৮০ সালে ‘কসাই’, ১৯৮২ সালে ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ও ‘দুই পয়সার আলতা’, ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’ ও ‘সখিনার যুদ্ধ’, ২০০৬ সালে ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’ ও ২০১০ সালে ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ উল্ল্যেখযোগ্য।

আমজাদ হোসেন যুক্তভাবে নুরুল হক বাচ্চুর সাথে ১৯৬৭ সালে সুমিতা দেবী প্রযোজিত ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

১৯৭০ সালে তার লেখা চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। আমজাদ হোসেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।

আমজাদ হোসেনের জীবন প্রচন্ড সফলতার, পুরস্কারের জীবন। ১৯৭৩ সালে ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনির বাচসাস পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে ‘নয়নমনি’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সংলাপের বাচসাস পুরস্কার, ১৯৭৮ ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ সংলাপ লেখক, শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার, শ্রেষ্ঠ সংগীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং শ্রেষ্ঠ সংলাপের জন্য বাচসাস পুরস্কার, ১৯৭৯ সালে ‘সুন্দরী’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকারের বাচসাস পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপের বাচসাস পুরস্কার, ১৯৮০ সালে ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকারের বাচসাস  পুরস্কার অর্জন করেন।

এছাড়া ১৯৯২ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৮ সালে  ইউরো সাহিত্য পুরস্কার ও ২০০৯ সালে ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে তিনি অসংখ্য টিভি নাটক লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন। ঈদে তার নাটক দেখার জন্য টিভি সেটের সামনে দর্শকের উপচে পড়া ভিড় থাকত।

কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন গত ১৮ নভেম্বর সকালে অচেতন হয়ে বিছানার পাশে পড়ে গিয়েছিলেন। পরে তার স্ত্রী সুরাইয়া আখতার দেখতে পেয়ে দ্রুত তাকে তেজগাঁও ইমপালস হাসপাতালে নিয়ে যান। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে থাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শুক্রবার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন তিনি। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আর আমজাদ ভাইয়ের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক


সোনালীনিউজ/বিএইচ

Wordbridge School
Link copied!