• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আর কত লাশ উপহার পেলে টনক নড়বে রাষ্ট্রের?


সেলিম আহমেদ ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯, ০৩:১২ পিএম
আর কত লাশ উপহার পেলে টনক নড়বে রাষ্ট্রের?

ঢাকা : ২০১০ সালে ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছিল শিশুসহ ১২৪ জন। ১০ বছর ঘুরে নিমতলীর পুনরাবৃত্তি হলো আবারো পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায়। ফের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে অঙ্গার হলো ৭৮ তাজা প্রাণ। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষ চিতার আগে পুড়ে মরলো অসহায় মানুষেরা। স্বামী হারালো স্ত্রী, মা হারালো ছেলে, সন্তান হারালো পিতা-মাতাকে আর স্বজনরা হারালো প্রিয়জনকে। এমন এক ভয়াবহতায় পোড়া লাশের গন্ধে ভারি হয়ে আছে আকাশ। সেই সাথে সুখে বিহ্বল পুরো দেশ, পুরো জাতি।

গণমাধ্যমে খবর এসেছে, রাত সাড়ে ১০টার কিছু সময় পর আচমকা চুড়িহাট্টার শাহি মসজিদ বা পাঁচরাস্তার মোড়ে পিকআপ ভ্যানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে সেখানকার বৈদ্যুতিক ছোট্ট ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর দেখেন চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুন জ্বলছে। দ্রুতই তা আশপাশের ভবনসহ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রলয়সম এই অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে বাসায় অবস্থানরত নারী-শিশু, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চিকিৎসক-রোগী, কারখানার মালিক-কর্মচারী-এমনকি বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রিত অতিথিও রয়েছেন; রয়েছেন পাশের সড়কে যানজটের কারণে আটকেপড়া যাত্রী, পথচারীও।

মুহূর্তেই আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার জায়গা নেই। নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারের পুকুর থেকে পানি টেনে আগুন নেভানোর জন্য লড়াই করা হয়েছে। বিমানবাহিনী ও পুলিশ পানি নিয়ে এসেছে। হেলিকপ্টারে করে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা হয়েছে। জীবন বাজি রেখে উদ্ধারকর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতে সক্ষম হন।

এর আগে নিমতলীতে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য রান্না চলাকালে চুলার তাপে পাশের একটি কেমিক্যালের গুদামে আগুন লেগেছিল। এরপর সরকারের উচ্চপর্যায়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল-খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য রাসায়নিকের ব্যবসা, কারখানা ও গুদাম স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু না! এর মাঝে পেরিয়ে গেছে প্রায় ১০ বছর; অথচ সেই ‘অল্প সময়’ আজও শেষ হয়নি। এসব এলাকা থেকে সরানো হয়নি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের দোকান, কারখানা ও গুদাম।

গত বুধবার রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডেও ব্যাপক প্রাণহানির পর বিষয়টি আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। কারণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চকবাজারে দাহ্য রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম থাকায় অগ্নিকাণ্ডে অনেক বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন তিন বছর ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পুরান ঢাকা থেকে দাহ্য রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম উচ্ছেদের কথা বলেছেন। সর্বশেষ, গত ১২ ফেব্রুয়ারিও তিনি ঘোষণা দেন নতুন অভিযানের।

তিনি বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত ২০টি রাসায়নিক যেসব প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাবে, সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন ডিএসসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। যেসব কারখানায় নিষিদ্ধ রাসায়নিক থাকবে না, সংশ্লিষ্ট কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী শুধু সেসব কারখানারই ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করা হবে; কিন্তু তার ঘোষিত সেই ‘অভিযান’ শেষ হয়েছে ডিএসসিসির কর্মকর্তাদের কারখানা ‘পরিদর্শনে’।

প্রায় ২০০ ধরনের ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের প্রায় ২৫ হাজার গুদাম রয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায়। এর মধ্যে মাত্র আড়াই হাজার গুদাম ডিএসসিসির ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্ত। ডিএসসিসির দায়িত্ব শুধু এসব প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স প্রদানই নয়, পর্যবেক্ষণেরও; কিন্তু প্রচারকেন্দ্রিক কিছু কর্মসূচিতেই দায় সারছে কর্তৃপক্ষ। আরও উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) গবেষণা প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়েছে, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের যে ২৫ হাজার গুদাম রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজারই হচ্ছে বাসাবাড়িতে। প্রতিবারই দুর্ঘটনার পর রাসায়নিকের ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা সরকারের দিকে আঙুল তুলে তাদের দায় এড়িয়ে যান। তারা বলছেন, রাসায়নিকের ব্যবসার জন্য পৃথক অঞ্চল করে দেওয়ার কথা থাকলেও সরকার তা দেয়নি। তাই বাধ্য হয়েই তারা ওই এলাকায় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পৃথক অঞ্চলে তো স্থানান্তর হবে অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান; কিন্তু অনুমোদনহীন ২২ হাজার গুদামের দায় তো এ খাতের ব্যবসায়ীদেরই নিতে হবে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত জানা যায়, নিমতলীতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার রাসায়নিকের দোকান, কারখানা ও গুদাম অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালে কেরানীগঞ্জের সোনাবান্দায় ২০ একর জমিতে রাসায়নিক পল্লী গঠনের কথা থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে চরম ধীরগতির কারণে শেষ পর্যন্ত ওই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয় তথ্যপ্রযুক্তির পার্ক করার জন্য। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিকের উদ্যোগে পরিকল্পনা কমিশনে দ্বিতীয় দফা বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রস্তাবনা (ডিপিপি) জমা দেওয়া হয়। নতুন এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ১৮৬ কোটি টাকা।

এ প্রকল্পে এখন জমির পরিমাণ আড়াইগুণ বাড়িয়ে ৫০ একর করা হয়েছে; প্লট থাকছে ৯১৪টি। তবে এসব প্রকল্প বা উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঝুঁকিমুক্ত হয়নি পুরান ঢাকা; যার নির্মম ফল চকবাজারের মৃত্যুপুরী।

নিমতলী ট্রাজেডির পর এরকম আর কোন দুর্ঘটনা যেন না ঘটে সরকারের ওপর মহলের সে আশ্বাসগুলো কবে আলোর মুখ দেখবে কি দেখবে না তা জানে না কেউ। হ্যাঁ, তবে আশ্বাসগুলো আলোর মুখ না দেখারই কথা। এটা বাংলাদেশ। এই দেশে ইস্যুর আড়ালে ঢাকা পড়ে ইস্যু। কোনো ঘটনা ঘটে। ঘটনা নিয়ে ক’দিন সরগরম থাকে পুরো দেশ। তারপর আরেক নতুন ইস্যুর জন্ম হয়। আমরা ভুলে যাই পুরনো ইস্যু। ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটি হয়। কোনো আলোর মুখ দেখে না তদন্ত রিপোর্ট।

আমাদের দেশে নকল জিনিসেরও দাম আছে। শুধু দাম নেই মানুষের জীবনের। দাম নেই নিমতলী, রানা প্লাজা, চুড়িহাট্টার মতো ঘটনায় নিহত নিরীহ মানুষের। এতো লাশ উপহার পাওয়ার পরও টনক নড়ে না রাষ্ট্রের।

লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!