• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আরব ঐক্য ভঙ্গের নিয়ামক হতে পারে আমিরাত


ফরহাদ আহমেদ সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২০, ০৫:৩৯ পিএম
আরব ঐক্য ভঙ্গের নিয়ামক হতে পারে আমিরাত

ঢাকা : বহু দশকের বিরোধের পাশাপাশি একাধিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে লড়াই করা ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত সমপ্রতি এমন একটি পদক্ষেপ নিয়েছে যা মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। সম্পর্কের ‘স্বাভাবিককরণ’-এর প্রয়োজনে করা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দেশ দুটি মূলত বৈশ্বিক রাজনীতিকদের দুই দলের মধ্যে বিভক্ত করে দিয়েছে। ফলে এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একটি অংশ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এবং অন্যরা আন্তরিকভাবে এটিকে সমর্থন করেছে। এমনকি এই শান্তি চুক্তিতে মধ্যস্থতার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার ব্যাপারেও সমর্থন জুগিয়েছে। তবে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরের মূল কথা এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা হলেও ফিলিস্তিনি স্বার্থপরিপন্থী হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের আরব ঐক্যকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। যদিও আমিরাতের পক্ষ থেকে বারবার করে বলা হয়েছে যে, এই চুক্তির কোনো প্রভাব এই অঞ্চলের জোটগুলোর ওপর পড়বে না বলে তারা মনে করে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এ বিষয়ে যতই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুক না কেন এই চুক্তির দুটি নেতিবাচক দিক কখনোই আরব বিশ্ব এড়িয়ে যেতে  পারবে না। প্রথমটি হলো, এই চুক্তির ফলে ফিলিস্তিনের অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা দুর্বল হয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে একটি বিষয় বিশ্ব জেনে নেবে যে, আরবরা নিজেদের স্বার্থে ফিলিস্তিন ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে ইসরাইলের নানা অপকর্ম সত্ত্বেও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে প্রস্তুত রয়েছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ইসরাইল সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে আরব বিশ্বের অন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন পোর্টালের মাধ্যমে আরব বিশ্বে ইসরাইল নিজেদের জন্য এজেন্ট নিয়োগেরও ক্ষমতা পাবে।

১৩ আগস্ট হোয়াইট হাউজে এই চুক্তির অংশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, ১৮ মাস আলোচনার পরে উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ বিষয়ে রাজি হয়েছে এবং ইসরাইল পশ্চিম তীরের সংযুক্তি স্থগিত রাখার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এভাবে ১৯৭৯ সালে মিসর এবং ১৯৯৪ সালে জর্ডানের পর ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরকারী তৃতীয় আরব দেশে পরিণত হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই আরব বিশ্বের স্বার্থ উপেক্ষা করে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তির কারণ হিসেবে আরব বসন্তকেও নির্দেশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে ছেদ টানে যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল আরব বসন্তের বিরোধিতা, যা আরব জনগণকে তার ইচ্ছা প্রকাশ এবং ইচ্ছা মতো সরকার নির্বাচনের ক্ষমতা প্রদান করেছিল। দ্বিতীয়টি ইরানের সাথে বৈরিতা। যেহেতু ইরান সংযুক্ত আরব আমিরাতের তিনটি দ্বীপ দখল করেছে এবং ইরান ইসরাইলী সীমান্তে রয়েছে। এই বিষয়গুলোর আন্তঃসংযোগই মূলত এই চুক্তিকে সম্ভব করে তুলেছে।

এই চুক্তির বিষয়ে আরব বিশেষজ্ঞদের মত হলো, চুক্তিটি ২০০২ সালের স্বাক্ষরিত  ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’ চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। যে চুক্তিটি ইসরাইলের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি করার বিষয়ে আরব দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে। ফিলিস্তিন ইস্যুই বর্তমান আরব রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যের সবচেয়ে বড় জায়গা। এখন আমিরাতের এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য যদি আরব রাষ্ট্রগুলোর সেই ঐক্য ভেঙে যায়, তবে অন্য যেকোনো ইস্যুতে এটি আবার নতুন করে তৈরি করা কঠিন হবে।

অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সীমানার সঙ্গে ইরানের লাগোয়া সীমানা রয়েছে। ভবিষ্যতে ইরানের সীমান্তের নিকটে আরব আমিরাতের ভেতর ইসরাইলের প্রথম সারির সামরিক ঘাঁটি হয়ে ওঠার খুব বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সাথে দ্বি-পাক্ষিক সংঘাত মোকাবিলায় পূর্ণ সুবিধা লাভ করবে। যার ফলে সংকট-বিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা আরো বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমিরাতের পরোক্ষ ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় থাকবে না। আর এভাবে পারস্য উপসাগরে মেরুকরণও বৃদ্ধি হতে পারে।

এর ফলে শুধু ইসরাইল আর যুক্তরাষ্ট্রেরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, আমিরাতের নয়। কেননা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষেও এক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিপদ রয়েছে। কারণ ইসরাইল যখনই আমিরাতকে ব্যবহার করে ইরানের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়াবে তখন ইরান কিন্তু বসে থাকবে না। ইরান লেবানন ও সিরিয়ায় নিজেদের ঘাঁটি ব্যবহার করে ইসরাইলকে এর জবাব দেবে।  মাঝখান থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হবে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তখন বর্তমানে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল উপসাগরীয় অঞ্চল আবার অস্থিতিশীল অবস্থায় পতিত হবে।

এই চুক্তির ঘোষণার পর ফিলিস্তিনের জনগণ তা প্রত্যাখ্যান ও নিন্দা প্রকাশ করে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তাদের দূতকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস চুক্তিটিকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ‘আগ্রাসন’ এবং তাদের ভবিষ্যত রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে পূর্ব জেরুজালেমের  নায্য দাবির বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করেছেন। ইসরাইল ও ফিলিস্তিন উভয় দেশেই প্রতিবাদকারীরা আমিরাতের পতাকা ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

এখন এই পরিস্থিতিতে আরব বিশ্বের কাছে একটি বার্তাই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, সেটা হলো আসন্ন সংঘাত মোকাবিলায় তাদের একে অপরের অবস্থান কি রকম হবে? কারণ সৌদি আরবের সঙ্গে ইরান, তুরস্কের যে উত্তেজনা ছিল সেখানেও ফিলিস্তিন ইস্যুতে কিছুটা হলেও যে ঐক্য ছিল সেটা আমিরাতের এই পদক্ষেপের কারণে আর থাকবে না। এ জন্য ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ভঙ্গের একক দায় যদি কাউকে বহন করতে হয় সেটা সংযুক্ত আরব আমিরাতকেই বহন করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী ও সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!