• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আ.লীগ নেতা ‘পাগলা মিজান’ ১৫ বছরেই গড়েছেন সম্পদের পাহাড়


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ১২, ২০১৯, ১১:০১ এএম
আ.লীগ নেতা ‘পাগলা মিজান’ ১৫ বছরেই গড়েছেন সম্পদের পাহাড়

ঢাকা : মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান দেশ ছেড়ে পালানোর সময় র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছেন। বিগত ১৫ বছর ধরে তার কোনো ব্যবসা নেই। তবু যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মিজানের আলিশান দুটি বাড়ি ও দামি গাড়ি থাকার সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মোহাম্মদপুরে গড়ে তুলেন অপরাধের সাম্রাজ্য। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, জমি দখল, টেন্ডারবাজির মাস্টার হিসেবে বেশ সুপরিচিত তিনি।

শুক্রবার (১১ অক্টোবর) সকালে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে তাকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান।

কথিত আছে, মিজান ১৯৭৫ সালে খামারবাড়ী খেজুরবাগান এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় পুলিশের ধাওয়া খেয়ে লালমাটিয়ায় মসজিদের পাশে পুকুরে নেমে পড়েন। পুকুরে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা ছিলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে পরনের পোশাক খুলে রেখে পাগল বেশে তিনি পুকুর থেকে উঠে আসেন। পুলিশ তাকে পাগল বলে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে তার নাম ‘পাগলা মিজান’।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাসায় যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ রয়েছে, পাগলা মিজান তাদের একজন। পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি থেকে শুরু করে মানুষ হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুন, সন্ত্রাসী ও কর্মকাণ্ডে তার নাম উঠে এসেছে বার বার।

মোহাম্মদপুরে পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে জমিদখল, টেন্ডারবাজি, প্রভাব বিস্তারসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে একাধিক মামলাও আছে। তিনি মোহাম্মদপুরবাসীর কাছে ত্রাস হিসেবে পরিচিত। সেখানকার বাসিন্দারা তার ভয়ে তটস্ত।

স্থানীয়রা জানান, পাগলা মিজান আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী। তিনি দল পাল্টে রাতারাতি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা হয়েছেন। পরে নেতাদের আশীর্বাদে অপরাধ সাম্রাজ্য গড়েন মোহাম্মদপুরে। মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে খুন-সন্ত্রাসী পর্যন্ত নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তার নাম বারবার উঠে এসেছে। অথচ সময়ের স্রোতে বদলে গেছে অনেক কিছু। ভোল পাল্টেছে তার, পাল্টেছে নামও।

মহাজোট সরকারের আমলে মিজান বাহিনী ৩০০-৪০০ কোটি টাকার শুধু টেন্ডারবাজিই করেছে। এ ছাড়া ভূমিদখল, চাঁদাবাজিসহ মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ও চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ মিজানের হাতে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, খুন-খারাবি পাগলা মিজানের বাম হাতের কাজ। এ কারণে এলাকায় কেউ তার ভয়ে কথা বলেন না।

এই পাগলা মিজান ২০১৪ সালে মোহাম্মদপুর এলাকায় ৬৫ বছরের বৃদ্ধ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমেদ পাইন ও তার অসুস্থ স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে তুচ্ছ ঘটনায় শত শত মানুষের সামনে জুতাপেটা করেন। কেউ ভয়ে কথা বলেননি। ক্ষমতাসীন দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা তার অপকর্মে সহযোগিতা করেন। এ কারণে অপরাধ করেও তিনি পার পেয়ে যান।

সূত্র জানায়, মিজান স্বাধীনতার পর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এসে চাঁদাবাজি, ছিনতাই শুরু করেন। তিনি ছিনতাইকারী হিসেবেই ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে বিশেষ পরিচিতি পায়।

চলমান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের শুরুতে একাধিক খুনের মামলা কাঁধে নিয়েও কিছুদিন তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান। তার নামে মোহাম্মদপুর থানায় ১৯৯৬ সালে ইউনূস হত্যা, ২০১৬ সালে সাভার থানায় জোড়া হত্যা মামলা রয়েছে। গত সপ্তাহে জমি দখলকে কেন্দ্র করে এক দল সন্ত্রাসী একটি রিয়েল এস্টেটের ছয় কর্মীকে গুলি এবং আরও ১৪ জনকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা জুয়েল নামের একজনকে হত্যা করে লাশ তুরাগে ফেলে দেয়। এ হত্যাকাণ্ডেও হাবিবুর রহমান মিজানের নাম উঠে এসেছে। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর সংঘর্ষের নেপথ্যেও রয়েছে মিজান।

জানা গেছে, মিজান ক্যাম্পের বিদ্যুৎ লাইন থেকে ক্যাম্প-লাগোয়া কাঁচাবাজার ও মাছের বাজারের তিন শতাধিক দোকানে অবৈধ সংযোগ দিয়ে মাসে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আয় করতেন। এ কারণেই বিদ্যুৎ অফিসের সঙ্গে ক্যাম্পবাসীর ঝামেলার সূত্রপাত।

মাদক কারবার থেকে শুরু করে খুনখারাবি পর্যন্ত নানা অপরাধে বারবার উঠে এসেছে এই মিজানের নাম। কয়েকবার জেলে গেলেও অল্প সময়েই ফের বেরিয়ে এসে ‘হাল ধরেছেন’ নিজের অপরাধ সাম্রাজ্যের। বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছেন।

সম্প্রতি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অনুসন্ধানে নেমে জানতে পারেন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে মিজানের সম্পর্কের কথা। জানতে পারেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অফিসে মিজান নিয়মিত অবস্থান করেন। বিষয়টি তারা সরকারের উচ্চ মহলে জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে বিব্রত হন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

এদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত এই ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) ভোরে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে তার এক বান্ধবীর বাসা থেকে আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ওই সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিন ও নগদ দুই লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এরপর তাকে ঢাকায় নিয়ে এসে প্রথমে লালমাটিয়ায় তার কাউন্সিলর কার্যালয়ে এবং পরে মোহাম্মদপুরে আওরঙ্গজেব রোডে তার বাসায় অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাব।  সেখান থেকে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক ও ১ কোটি টাকার এফডিআর উদ্ধার করে র‌্যাব।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, তার বাসা থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, দুই লাখ টাকা নগদ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া শ্রীমঙ্গলে আটকের সময় তার কাছ থেকে ছয় কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক, এক কোটি টাকার এফডিআরসহ অস্ত্র-গুলি উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব সেখান থেকে বৃহস্পতিবার তোলা ৬৮ লাখ টাকার ডকুমেন্টস পাওয়া গেছে। সেই টাকার সন্ধানে তার বাসায় তল্লাশি চালাচ্ছেন র‌্যাব সদস্যরা। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, বিভিন্ন ডেভেলপার্স কোম্পানির জমি দখলে সহায়তার জন্য এসব চেক তাকে দেওয়া হয়েছিল।’

সারোয়ার আলম আরো বলেন, ‘গত ১৫ বছর ধরে মিজানের নিজস্ব কোনও ব্যবসা নেই। কাউন্সিলর হিসেবে যে সম্মানী (৩৬ হাজার টাকা) পান সেটিই তার একমাত্র আয়ের উৎস। তবে উদ্ধার হওয়া কোটি টাকা ও বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কীভাবে হয়েছে মিজানের? আমরা ধারণা করছি, এসব সম্পত্তি সে অবৈধ অর্থ দিয়ে গড়েছেন।’

সোনালীনিউজ/এএস

Wordbridge School
Link copied!