• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইভিএমে ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে ব্যালটে ফেরা উচিত


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ২৩, ২০২০, ০১:২০ পিএম
ইভিএমে ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে ব্যালটে ফেরা উচিত

ঢাকা : নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কার্যকালের সর্বাধিক গুরুত্বসম্পন্ন নির্বাচন। এই নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

বুধবার (২২ জানুয়ারি) ইসির আইন-শৃঙ্খলা বৈঠকে এ মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র অবলম্বন। সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ অংশে বলা হয়েছে- “প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে”। এজন্য অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ আইনানুগ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন এত গুরুত্বপূর্ণ।

যারা সত্য মূল্য না দিয়ে অবৈধভাবে নির্বাচিত হন, তাদের দ্বারা প্রশাসনে ‘জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হতে পারে না। সংবিধানের প্রতিটি নির্দেশ প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকের পরিপালন বাধ্যতামূলক।

তিনি বলেন, আমরা সম্ভবত আত্ম-সমালোচনা বিমুখ। কেনো নির্বাচন নিরপেক্ষ শুদ্ধ ও স্বচ্ছ হয় না- এ প্রশ্নের উত্তর আত্মজিজ্ঞাসার কারণেই আমাকে খুঁজতে হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন আইনত স্বাধীন কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দী। এই বন্দীত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার।

তিনি আরও বলেন, আমার আত্মজিজ্ঞাসার আর একটি বিষয় আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ছাড়া এ পর্যন্ত প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে প্রচারাভিযানে যে সংযোগ সাধন দেখা যাচ্ছে, তাতে জনগণের নির্বাচনমুখীনতার বিষয়ে আমি খুবই আশাবাদী।

কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা, ঢাকা মহানগরী জুড়ে এখন নির্বাচনের যে উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে তার কিছুই দৃশ্যমান হয়নি কেন? জাতীয় নির্বাচন কি এই স্থানীয় নির্বাচনের চেয়ে কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল? এই অবস্থা কি নির্বাচন প্রক্রিয়া বা নির্বাচন ব্যবস্থার কোনও সঙ্তট থেকে উদ্ভুত?

এ প্রশ্নের জবাব আমাদের খুঁজতে হবে ভবিষ্যতের নির্বাচনকে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার স্বার্থেই। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার নেতিবাচক দিকগুলো পর্যালোচনা করে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে যাতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন। নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি। নির্বাচন কমিশন তাদের মাধ্যমেই নির্বাচন করে থাকে। আমি বিশেষভাবে পুলিশবাহিনীর কথা বলি। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অবদান সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে।

কিন্তু নির্বাচনকালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে নির্বাচন কমিশনের অধীন, তা দৃশ্যমান নয়। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট পুলিশ আইনানুগভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত, কিন্তু মানসিকভাবেও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত না হলে কোনও ফল লাভ হবে না।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যারা নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট থাকবেন, তাদের কাছে প্রত্যাশা, তারা নিজেদের কার্যক্রমে আইন ও শৃঙ্খলা শব্দ দুটির বিশেষ তাৎপর্য অনুধাবন করবেন।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতি উৎসাহী কোনও কোনও সদস্যকে আইন ও শৃঙ্খলা ভঙ করতে কিংবা প্রয়োজনের সময় নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যায়। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা থেকে বিরত থাকার জন্যরর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি একান্ত জরুরি।

পুলিশ সপ্তাহ ২০২০ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’। জনতার ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করে পুলিশ বাহিনী এই অঙ্গীকার পালন করতে পারে। আমার পরামর্শ আপনাদের মনে ইতিবাচক সাড়া জাগবে বলে আশা করি। আর একটি কথা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ওয়ারেন্ট ছাড়া কিংবা নতুন ওয়ারেন্ট বা পূর্বের ওয়ারেন্ট দিয়ে যে সকল গ্রেফতার করা হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের বরখেলাপ। জরুরি ক্ষেত্র বিশেষ ব্যতীত গ্রেফতার কার্যক্রম নির্বাচনের পরে হলে অসুবিধা কি?
অনেক সময় এসব গ্রেফতারে নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রার্থী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে মামলা দিলেও তা যেন ‘গায়েবি মামলা’ হয়ে না যায়। অন্যদিকে গ্রেফতারের বিষয়ে আমার প্রশ্ন, গ্রেফতারকালে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশগুলো মানা হয় কি?

২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার বনাম ব্লাস্ট-এর মামলার রায়ে সুপ্রিমকোর্ট গ্রেফতার ও রিমান্ড সম্পর্কে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা যথাযোগ্যভাবে অনুসরণ করা হয় বলে আমার জানা নেই। আপিল বিভাগের নির্দেশনাটিতে মানবিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখার যে অভিব্যক্তি রয়েছে তা যথাযথভাবে পরিপালিত হলে পুলিশের আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা অনেক কমে যাবে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতভেদ আছে। ইভিএম ব্যবহারে সকল রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের মধ্যে ঐক্যমত্য প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমাদের নির্বাচনি ব্যবস্থায় এ ধরনের সমঝোতার রীতি গড়ে ওঠেনি।

ইভিএম নিয়ে পূর্বে আমি ক্রিটিকাল থাকলেও দুটি কারণে আমি এখন ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে।

একটি হচ্ছে, এতে ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে বাক্স ভর্তি করার সংস্কৃতির অবসান ঘটতে পারে।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, নির্বাচনে কোনও কোনও কেন্দ্রে শতকরা শতভাগ ভোট পড়ার যে অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি, ইভিএম ব্যবহারে তারও অবসান হবে।

তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদের ফলাফল, যা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, জাতীয় সংসদের ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। পৃথিবীতে কোনও নির্বাচনেই এ ধরনের ভোটার উপস্থিতির নজির নেই। রাতে ব্যালট পেপারে বাক্স ভর্তি ও কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার অপবাদ থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই।

যা হোক, ইভিএম-এর বিরুদ্ধবাদীদের বলতে চাই, বর্তমানের রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, যে কোনও অবস্থাতেই আসন্ন দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহৃত হবে। এর কোনও অন্যথা হবে না।

যারা ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করছেন, তাদের বক্তব্য অনেক সময় তাদের সমর্থক ভোটারদের মনেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায়, তাদের সমর্থক ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ইভিএম-এ ভোট দিতে আগ্রহী হন, এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক।

আমার পরামর্শ হচ্ছে, ইভিএম-এর জানাজা না পড়ে বরং এর জন্ম উৎসব পালনের কথা বিরোধিরা ভাবতে পারেন। চট্টগ্রাম-৮ আসনের সাম্প্রতিক উপ নির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এতে ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট পড়েছে।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম বিহীন ব্যালট পেপারে যে ২৯৪টি আসনে ভোট হয়েছে, ভোটের হার যেখানে ছিল শতকরা ৮০ ভাগ, সেখানে ইভিএম ব্যবহারে ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম ভোট পড়েছে। এর কারণ ইভিএম নিয়ে ভোটারদের মনে আছে ইভিএম ভীতি।

অন্যদিকে ইভিএম-এ জাল ভোট প্রদান প্রতিহত করা এক বিরাট সমস্যা। বুথ দখল করে বা গোপন কক্ষে গিয়ে জাল ভোট প্রদানের ঘটনা অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের সম্মিলিতভাবে গোপন কক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

বর্তমান সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার কমিশনের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বৃদ্ধিও একান্ত অপরিহার্য। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে এই যন্ত্রটির ভবিষ্যত।

এই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ হলে শুধু নির্বাচন নয়, ইভিএম যন্ত্রটির ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। আমার মতে যে কোনও নির্বাচনে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পড়লে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এজন্য বিশ্বের অনেক দেশে ৫০ শতাংশের কম ভোট পড়লে পুনরায় ভোট গ্রহণ করা হয়।

ইভিএম সম্পর্কে আমার বক্তব্যের বটম লাইন হলো, ইভিএম-এ যদি ৫০ শতাংশ ভোট না পড়ে, তাহলে ব্যালট পেপারে পুনরায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এজন্য নির্বাচনি বিধি-বিধান পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে।

‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সমান সুযোগ প্রতিটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার পূর্বশর্ত। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে এই দায়িত্ব সুসম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এজন্য সরকার, সরকারি দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা একান্ত অপরিহার্য।

নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত না হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে তার দায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর এসে পড়বে। আর আপনারা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তার দায় আমাদের ওপর বর্তাবে। আমরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে কলঙ্কিত হতে চাই না।

ইসি মাহবুব বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রিয় শীর্ষ কর্মকর্তাবৃন্দ, আমি বিশ্বাস করি নির্বাচনের সর্বপ্রকার শৈত্যপ্রবাহ কাটিয়ে আপনারা রাজধানীবাসীর মনে উষ্ণতা ছড়াতে পারবেন।

বিশেষভাবে বলতে চাই, ঢাকার উভয় সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মুজিববর্ষে। আমি মনে করি, এই নির্বাচন সুন্দর সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমে আমরা জাতির জনকের প্রতি সর্বোত্তম উপায়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!