• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

‘উত্তেজক ওষুধ খেয়ে তরুণ-তরুণীর মৃত্যু’ বেরিয়ে এলো লোমহর্ষক তথ্য!


নিজস্ব প্রতিবদক মে ২২, ২০১৯, ০৯:৪৩ পিএম
‘উত্তেজক ওষুধ খেয়ে তরুণ-তরুণীর মৃত্যু’ বেরিয়ে এলো লোমহর্ষক তথ্য!

ঢাকা: রাজধানীর ফার্মগেটে আবাসিক হোটেল থেকে দুই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধারের পর এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও পুলিশ কোনো ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেনি। অথচ লাশ উদ্ধারের পরপরই পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবন করে তাদের মৃত্যু হয়েছে। তবে পরিবারের দাবি, পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করে তা ধামাচাপা দিতেই যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবনের কথা বলা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, যৌন উত্তেজক ওষুধ সেবনে তারা মারা গেছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, পুরুষের সেবন করা যৌন উত্তেজক ওষুধে নারীর মৃত্যুর কোনো নজির নেই।

গত ২ এপ্রিল ফার্মগেটের আবাসিক হোটেল সম্রাটের ৮০৮ নম্বর কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রী মরিয়ম চৌধুরী (২০) ও তেজগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র আমিনুল ইসলাম সজলের (২২) মরদেহ।

সজলের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার হরিপুর গ্রামে। আর মরিয়মের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলায়। লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশ ও হোটেল কর্তৃপক্ষ দাবি করে, যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবন করে দুই জন মারা গেছেন।

সজলের পকেটে ডুমেক্স-৬০ নামে দুটি যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট পাওয়া গেছে। তা দেখেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে পুলিশ। পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুজনের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। আত্মহত্যাও করেননি তারা।

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রী মরিয়ম চৌধুরী (২০) ও তেজগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র আমিনুল ইসলাম সজলের (২২) ২ এপ্রিল রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর থেকে পুলিশ ও হোটেল কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক আচরণ করছে। হোটেলের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ মরিয়ম ও সজলের পরিবারকে দেখানো হয়নি।

হোটেলের এক কর্মকর্তা বলেছেন, সব ফুটেজ পুলিশ নিয়ে গেছে। অন্যজন আরেক কর্মকর্তা বলেছেন, সব সিসি ক্যামেরা নষ্ট ছিল। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এ ঘটনায় তারা হত্যা মামলা করতে চাইলেও পুলিশ অপমৃত্যুর মামলা নিয়েছে। এমনকি ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দিতে চেয়েছিল পুলিশ। এ নিয়ে তারা অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পাচ্ছেন না।

পুলিশের দাবি, ঘটনাস্থল থেকে ডুমেক্স নামের একটি যৌন উত্তেজক ট্যাবলেটের পাতা পাওয়া গেছে। ওই পাতায় দুটি ট্যাবলেট ছিল না। পুলিশ বলছে, ওই ট্যাবলেট সেবনের কারণেই মরিয়ম ও সজলের মৃত্যু হয়েছে। তাদের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে পরিবারের দাবি, মরিয়ম তৃতীয় কারও লালসার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনার সাক্ষী না রাখতেই হয়তো সজলকেও খুন করা হয়েছে। পুলিশ ও হোটেল কর্তৃপক্ষ সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবনের নাটক সাজিয়েছে।

এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, দুটি ডুমেক্স ট্যাবলেট সেবন করলে কারও মৃত্যু হয় না। পুরুষের যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবনের কারণে নারীর মৃত্যু হওয়ার ঘটনাও নজিরবিহীন। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তাদের মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর এবং যৌন ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার গণমাধ্যমকে বলেন, দুটি ডুমেক্স সেবন করলে সাধারণত কারও মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। যদি অন্য কোনো রোগ না থাকে। দুটি কেন, তিনটি সেবন করলেও কারও মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। আর এটি সেবন করলে নারীর মৃত্যু হবে না। অন্য কোনো কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ এটা বললে তা অতি উৎসাহী হয়ে বলেছে।

গত ২ এপ্রিল ফার্মগেটের আবাসিক হোটেল ‘সম্রাট’-এর ৮০৮ নম্বর কক্ষ থেকে দুই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ যে বক্তব্য দিয়েছিল এখন সেখান থেকে সরে এসেছে। ওই সময় তেজগাঁও থানার এএসআই আলমগীর হোসেন গণমাধ্যমে বলেছিলেন, সজলকে খাটে শোয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। আর মরিয়ম মেঝেতে পড়েছিল। হয়তো যৌন উত্তেজক কোনো ট্যাবলেট খেয়ে তারা মারা গেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, এএসআই আলমগীর যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা তার নিজস্ব বক্তব্য। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও ভিসেরা প্রতিবেদন না পেলে পুলিশ কোনোভাবেই এটা বলতে পারে না।

মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়টি এখনও রহস্যজনক। তাদের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কিভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে বলা যাবে। তবে অন্যসব বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে।

মরিয়ম চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের কোলা গ্রামে। তার বাবা মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় মেয়েকে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মেয়েটাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ লাশের ময়নাতদন্তও করতে চায়নি। থানায় তিন ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিল। ঢাকা থেকে মেয়ের লাশ আর কলঙ্ক নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।

মোস্তাক আহমেদ আরও বলেন, হয়তো তৃতীয় কারও লালসার শিকার হয়েছে তার মেয়ে। কোনো সাক্ষী যেন না থাকে সেজন্য সজলকেও হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, গ্রামে থাকতে মরিয়মের সঙ্গে একটি ছেলের সম্পর্ক ছিল। পরে ওই ছেলে মরিয়মকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিল। জমিজমা সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে আমাদের। এসব বিষয় পুলিশ তদন্ত করে দেখতে পারে। জিগাতলার মুন্সীবাড়ী রোডের একটি নারী হোস্টেলে মরিয়ম ভাড়া থাকতেন।

ওই নারী হোস্টেলের পরিচালক আমেনা বেগম জানান, গত ১ এপ্রিল রাতে মরিয়ম তার খালার বাসায় যাওয়ার কথা বলে হোস্টেল থেকে বের হন। তখন সে জানিয়েছিল, রাতে বাসায় ফিরবে না। এদিকে সজলের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের হরিপুর গ্রামে। তার বাবা মোশারফ হোসেন বলেন, তার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। অথচ পুলিশ অপবাদ দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। জিগাতলার হাজী আবদুল হাই রোডের একটি মেসে সজল ভাড়া থাকতেন। সজলের সহপাঠী ও রুমমেট কামরুল হাসান জানান, গত ১ এপ্রিল রাতে আত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে সে বের হয়। পরের দিন তারা মৃত্যুর সংবাদ পান।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে লুকোচুরি করছে সম্রাট হোটেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ। সিসি ক্যামেরার ফুটেজের বিষয়ে জানতে চাইলে হোটেলের ব্যবস্থাপক রাসেল আহমেদ সুমন বলেন, সব ফুটেজ পুলিশ নিয়ে গেছে। অপরদিকে হোটেলের তত্ত্বাবধায়ক আহাম্মদ হোসেন বলেন, সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট ছিল। তবে পুলিশের দাবি, ৯ তলা ভবনের টাইলসের দোকানে শুধু সিসি ক্যামেরা সচল ছিল। ওই ক্যামেরায় সজল ও মরিয়মের প্রবেশের দৃশ্য দেখা গেছে।

সম্রাট হোটেলের ৮০৮ নম্বর কক্ষ থেকে সজল ও মরিয়মের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ওই কক্ষের টয়লেটের ওপরের ফাঁকা জায়গা দিয়ে খুব সহজে ৮০৮ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করা যায়। ওই ফাঁকা জায়গা দিয়ে খুনিরা বেরিয়ে গেছে কিনা এ নিয়ে স্বজনরা প্রশ্ন তুলেছেন।

মরিয়মের বাবা মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী বলেন, সজল ও মরিয়ম স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে হোটেলে উঠল কিভাবে? তাদের কাছে তো বিবাহের কোনো কাগজপত্র ছিল না।

এ বিষয়ে হোটেলের তত্ত্বাবধায়ক আহাম্মদ হোসেন বলেন, তারা সব ডকুমেন্ট দেখিয়ে হোটেল ভাড়া নিয়েছিল। এগুলো পুলিশকে দেয়া হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!