• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
ছয় মাসে অর্থনীতির চালচিত্র

উন্নয়ন ব্যয়ের চেয়ে ঋণ বেশি


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯, ০৪:৪১ পিএম
উন্নয়ন ব্যয়ের চেয়ে ঋণ বেশি

ঢাকা : গত অর্থবছরের (২০১৭-১৮) প্রথম ছয় মাসে সরকারের রাজস্ব আদায় ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়লেও চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্যের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ৯৮ হাজার ২৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ছয় মাসে রাজস্বের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৯৯৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

একদিকে কম আদায় অন্যদিকে বাড়তি ব্যয়ের চাহিদা মেটাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণের অর্থ ঋণ করতে হচ্ছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকারের ঋণের পরিমাণ একই সময়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ব্যয়কে ছাড়িয়ে গেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগসহ (আইএমইডি) সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থার পৃথক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ইআরডি সূত্র জানায়, জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিদেশি সহায়তা বাবদ পাওয়া গেছে ২২০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। একই সময়ে সরকারের ব্যয় মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাবদ সংগ্রহ করা হয়েছে ২৪ হাজার ৯৯৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সারা বছরের লক্ষ্যের প্রায় শতভাগ অর্থ ছয় মাসেই সঞ্চয়পত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এর বাইরে ৭ হাজার ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। সব মিলে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে সরকার অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৫০ হাজার ৮৪৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। একই উন্নয়ন কাজ তথা এডিপি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার ৬৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ হিসাবে উন্নয়ন ব্যয়ের চাইতে ছয় মাসে ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা বেশি ঋণ করেছে সরকার। সরকারের ঋণ উন্নয়ন ব্যয় ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের অসঙ্গতি হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, এডিপি বাস্তবায়নের চাইতে বেশি ঋণ করার অর্থ হলো সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন পরিশোধের মতো অনুন্নয়ন কাজে ব্যয় হচ্ছে ঋণের অর্থ। সাধারণত সরকারের রাজস্বের সঙ্গে ঋণের অর্থ মিলিয়ে উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা হয়ে থাকে। সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের অদক্ষতার কারণে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও অন্যান্য ব্যয় মোটানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রাজস্ব আয় থেকে এ ধরনের ব্যয় প্রথমে মেটাতে হয়। আর উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে রাজস্বের অর্থের পাশাপাশি ঋণের অর্থও ব্যয় করা হয়ে থাকে। তবে ঋণ নিয়ে অনুন্নয়ন ব্যয় মেটানোর নজির খুব একটা নেই। সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপানয় বড় ধরনের ঘাটতি না থাকলে সঞ্চয়পত্র থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নেওয়া হতো না। তিনি আরো বলেন, বিদেশি ঋণের সুদের হার খুবই কম। আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি ঋণ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এসব কিছু বিবেচনায় বিদেশি সহায়তা ছাড় বাড়াতে প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর সূত্র জানায়, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২৪ হাজার ৯৯৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এবারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সারা বছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সারা বছরের লক্ষ্যের ৯৫ শতাংশের বেশি অর্থ ছয় মাসেই সঞ্চয়পত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। পুঁজিবাজারের অস্থিরতা আর ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবে সুদের হার কম থাকায় গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্রে বাড়তি অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সম্প্রতি ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কিছুটা বাড়ানোর পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রি খুব একটা কমেনি।

অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিদেশি সহায়তা ছাড় হয়েছে আগের বছরের একই সময়ের দ্বিগুণ অর্থ।

ইআরডি সূত্র জানায়, জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিদেশি সহায়তা বাবদ এসেছে ২২০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১৮ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ১১০ কোটি ডলার। বিদেশি সহায়তায় নেওয়া বড় আকারের প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আসায় অর্থ ছাড় বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকারের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ এডিপি বাস্তবায়নে মোট ৪৯ হাজার ৬৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমইডি। এবার ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এ হিসাবে ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বিদেশি সহায়তার ৬০ হাজার কোটি টাকা থেকে ২৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, অর্থাৎ ১৭ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে ছয় মাসে। আর বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। অবশ্য জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে এডিপি বাস্তবায়নের সার্বিক হার ৩৪ দশমিক ৪৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমইডি।

রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতার কারণে বিপুল ব্যয়ের চাহিদা মিটছে না। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা লক্ষ্যের বিপরীতে ছয় মাসে রাজস্ব বাবদ আদায় হয়েছে ৯৮ হাজার ২৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। লক্ষ্য থেকে ২৭ হাজার ৯৯৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা পিছিয়ে আছে এনবিআর। সারা বছরে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৯৮ হাজার ১৭৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

প্রত্যাশিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারের শীর্ষ মহলে কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে। রাজস্ব পাওয়া যাচ্ছে না এমন কিছু এলাকা ইতোমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং মূল্য সংযোজন কর ও কাস্টমস সংশ্লিষ্ট সদস্য এবং কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি বলেন, প্রতিটি এলাকায় কর অফিস থাকবে। কর আহরণে অটোমেশনসহ প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি করা হবে। সব এলাকা থেকে প্রত্যাশিত রাজস্ব আহরণ করা হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশের কম রাজস্ব আদায় হলে প্রত্যাশিত উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে না। ঋণ আর অনুদানে নির্ভরতা থেকে বের হতে হলে কর আদায়ের পরিমাণ অবশ্যই বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে বেশকিছু খাতে সংস্কার করতে হবে। ভ্যাট আইন কার্যকর করা, অটোমেশন, করের হার কমিয়ে আওতা বাড়ানোর মতো উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তিনি।

প্রত্যাশিত হারে রাজস্ব না আসায় সরকারের ব্যাংক ঋণও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত ছয় মাসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৭ হাজার ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ৪৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর অর্থবছরের শুরুতে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। পরিশোধ সত্ত্বেও ছয় মাসে ব্যাংকে ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!