• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দশ জানুয়ারি এবং জন্মশতবর্ষ


মামুন মুস্তাফা জানুয়ারি ১০, ২০২০, ১০:৩৮ এএম
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দশ জানুয়ারি এবং জন্মশতবর্ষ

ঢাকা : সাতচল্লিশের দেশভাগের শেকড়বিচ্যুতি থেকে উত্তরণের পথে যখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, সাথে এদেশীয় দোসর তখন বাঙালির সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্রে অব্যবস্থা, লোভ, বিশ্বাসঘাতকতা ও ধর্মান্ধ জাতীয়তা এবং পরবর্তীকালে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে মধ্যবিত্তের বিকাশের ধীর, সুষ্ঠু ও আত্মপ্রত্যয়ী ধারাটিকে ক্রমান্বয়ে নিষ্ক্রিয় করে তোলে। সে সময়কার পাকিস্তান শাসনযন্ত্রে যে ফ্যাসিবাদী স্বেচ্ছাচারের প্রকাশ ঘটে তার অনুরূপ চরিত্রের প্রতিফলন ঘটে সে-সময়ের বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। সেই প্রেক্ষাপটে একজন নেতার খুব প্রয়োজন ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান— সেই নাম, যিনি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন বাঙালির মর্মব্যথা, হয়তো কথাও। আর তাই বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই বলা সম্ভব ছিল, ‘আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই।’ বাঙালির এই মহানায়ক ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, সামরিক শাসক আইয়ুবের বেসিক ডেমোক্রেসি, ৬-দফা, ১১-দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা— এ সবকিছুর সূচাগ্র ভেদ করে বাঙালির বিশ্বাসের প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান এগিয়ে গেলেন বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষায়। সুতরাং এ-সময়ে রাষ্ট্রচরিত্রে যে নৈরাজ্য ও অবক্ষয়, আবিলতা ও অশ্রু— এ সমস্ত কিছু ঠাঁই করে নিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ও তার মানসচারিত্র্যে। তারই প্রতিফলন ঘটে শেখ মুজিবুর রহমানের সমস্ত অবয়বে। তাকে কেন্দ্র কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতায় উচ্চারণ করেন— “আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,/... কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,/... বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,/অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও/রফিজ আমাকে চিনলো না।/... আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,/... খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,/তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য।/রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস।/ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:/ — আমাদের ভবিষ্যৎ কী?/ — আইয়ুব খান এখন কোথায়?/ — শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?/ — আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?/... কণ্ঠ থেকে অক্ষম বাসনার জ্বালা মুছে নিয়ে বলবো:/‘আমি এসবের কিছুই জানি না,/আমি এসবের কিছুই বুঝি না’।”     

সেই বিপন্ন সময়ে যেভাবে নেমে এসেছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবদমন, তার পাশাপাশি বাঙালিকে লড়তে হয়েছিল তার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির জন্যে। আর সেই লড়াই চূড়ান্ত লড়াইয়ে পরিণত হলো মুক্তির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের বীভৎসতা বাংলাদেশের মানুষের ভাবনায় ছিল না, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো। নয় মাসের দীর্ঘ মুক্তির যুদ্ধে বাংলাদেশ শুধু যে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো তা-ই নয়, অনেক প্রাণহানি, নারীর সম্ভ্রম হারানোর পাশাপাশি জন্ম নিল অনেক যুদ্ধশিশু এবং জাতিকে মেধাশূন্য করা হলো সুপরিকল্পিতভাবে। কিন্তু এসবের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। তাই বাঙালির বীর মহাকালের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি হলেন ঠিকই, মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন না। তাই তো ১০ জানুয়ারি তাঁর প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জিত হলো।

আজ আমরা সেই সুস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে, যখন জাতি হিশেবে আর একটি বছর পরে আমরা পালন করব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আর তার প্রাক্কালে এ বছর উদযাপন করছি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। যা ‘মুজিববর্ষ’ হিশেবে পরিচিতি পাচ্ছে দেশে-বিদেশে। জাতির পিতার সারা জীবনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই, তিনি কখনো ক্ষমতার পেছনে দৌড়াননি। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। আর তাতে অবিচল থেকে তিনি সমসাময়িক আরো অনেক বড় রাজনীতিবিদকে ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। আর এ কারণেই বিশ্বনেতৃবৃন্দ এবং বিদেশি সংবাদমাধ্যমও জাতির পিতার সুদৃঢ় ব্যক্তিত্বের গুণকীর্তন না করে পারেনি। কিউবার প্রখ্যাত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে বলতে শুনি, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ নিউজউইক বঙ্গবন্ধুকে উল্লেখ করেছিল ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ নামে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা মন্তব্য করেছিল ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না’।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার পর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। রক্তগঙ্গায় ভিজে ওঠে বাংলার মাটি। বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনে বাংলার স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে উদিত হয় নতুন দেশ- বাংলাদেশ।

বাঙালির মহানায়ক ফিরে এসেই দেশগড়ার যে রূপরেখা দিলেন, সেখানে মা-মাটি-মানুষের নিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার আখরে বাংলাদেশের আপামর মানুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধীনতার যে বীজমন্ত্র হূদয়ে ধারণ করেছিল তার বিনাশ অতি দ্রুত যেন ঘটতে থাকে কিছু পরাজিত মুখোশের ছদ্মাবরণে। যখন দেখি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেই দানা বাঁধে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্রমবিলীয়মান রূপ, স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং অপারেশন থিয়েটারে কাটাছেঁড়ার মতো ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে যে যার মতো সংবিধানকে করল ক্ষতবিক্ষত। অথচ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বলি হতে হলো ধর্মান্ধ মুসলমান নামের নরপিশাচদের হাতে সংখ্যালঘু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে উদার মুক্তমনা মুসলমান সম্প্রদায়কেও।

কিন্তু আজ আমরা সেসব অন্ধকারকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শামিল হয়েছি। আর এটি সম্ভব হয়েছে জাতির পিতার হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে। জাতি আজ কলঙ্কমুক্ত। আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠনে এখন প্রয়োজন তারুণ্যের শক্তি। যে তরুণের রক্তশোণিত বেয়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সেই বিজয়ধারা সমুন্নত রাখতে আজ নতুন প্রজন্মের তারুণ্যকে এগিয়ে আসতে হবে ইতিহাসের সত্য-স্মারকচিহ্নিত পথ বেয়ে। এই সত্যকে বুঝতে পেরে, ওই তরুণকেই উদারচিত্তে গ্রহণ করে নিয়েছে আমাদের বর্তমান সরকার। এখন এই তারুণ্যের শক্তিকে সঙ্গী করে সামনে থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার পালা।

১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশ আজ মনে করে, জাতির পিতার স্বপ্নপূরণে বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশীল রাষ্ট্র হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বর্তমান নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। বাঙালির বিজয়গাথা অক্ষুণ্ন রাখতে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা করা। সুতরাং ১০ জানুয়ারি শুধু দিবস পালন নয়, আজ আমাদের অঙ্গীকারের দিন। এই অঙ্গীকার দৃপ্ত শপথে রূপ নিক বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে। দেশ আজ এগিয়ে চলেছে জাতির পিতার রেখে যাওয়া দিকনির্দেশনা অনুসরণ করেই। ফলে তার উত্তরসূরিদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ। এই উন্নয়নধারায় বাংলার আপামর মানুষ আজ শামিল হয়েছে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রবে, এটাই কামনা।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!