• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উন্নয়নের মহাসড়কে ক্ষুধার্ত শ্রমিকের লাশ


সাকিব আনোয়ার ডিসেম্বর ২২, ২০১৯, ০৮:২৮ পিএম
উন্নয়নের মহাসড়কে ক্ষুধার্ত শ্রমিকের লাশ

ঢাকা : গত ১৮ ডিসেম্বর আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ১৯তম স্প্যান বসানো হয়েছে। আর গত ৮ ডিসেম্বর দেশি-বিদেশি তারকাদের উপস্থিতিতে জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত বঙ্গবন্ধু বিপিএল। ঠিক একই সময়ে খুলনা, রাজশাহী, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের পিএফ-গ্র্যাচুইটির টাকা দেওয়াসহ ১১ দফা দাবিতে আমরণ অনশন করছেন। তিন দিন কেটে গেলেও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোনোরকম আশ্বাস আসেনি। একদিকে পদ্মা সেতুর স্প্যান বসছে আর তার মধ্যেই জানা গেল অনশনে অংশ নেওয়া প্রায় শতাধিক শ্রমিক টানা তিন দিনের অনাহারে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সবচেয়ে মর্মান্তিক খবরটা এলো দিনের শেষে। অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়া একজন পাটকল শ্রমিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। ওদিকে ডংকা বেজে চলেছে উন্নয়নের। ডংকার তালে নেচে চলেছি আমরা।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে শ্রমিকদের ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের বেতন বকেয়া রয়েছে। সাপ্তাহিক হিসাবে মজুরি পাওয়া এসব গরিব অসহায় শ্রমিকদের জন্য এটি কতটা কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। অন্তত এই মৃত্যুর ঘটনার পর তা পরিষ্কার। সংকট কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। গত নভেম্বর মাস থেকেই পাটকল শ্রমিকরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে তাদের প্রতিনিধিরা কথা বলেছেন। কিন্তু সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। হয়তো সরকার মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকের পরিবারকে ৫০ হাজার বা এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়মুক্ত হবে। কিন্তু অসহায় শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে কি? ওদের নিয়ে বছরজুড়ে সভা-সেমিনার হবে না। হয়তো পত্রিকায় কদিন লেখালিখি হবে। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, কলামিস্ট, সমাজকর্মীরা কয়েক দিন সোচ্চার হবেন, বিবৃতি দেবেন। তারপর একসময় আমরা সবাই ভুলে যাব এই মৃত্যুর কথা।

একদিকে বাড়ছে আমাদের জিডিপি, মাথাপিছু আয়; অন্যদিকে হাহাকার বাড়ছে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরদের। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেট দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ওদিকে ধানের দাম না পেয়ে টাঙ্গাইলে কৃষক তার পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন, ক্ষেতের পাকা ধান এলাকাবাসীকে বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছেন, ফরিদপুরে পাটচাষি কৃষকরা পাটের নায্য দাম না পেয়ে শত শত মানুষের সামনে পাটে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন, দুধের দাম না পেয়ে পাবনায় খামারিরা রাস্তায় দুধ ঢেলে দিয়েছেন। ঋণের দায়ে কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এসব কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বিবেককে স্পর্শ করেনি। বরং ধানে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনায় রাষ্ট্র খুঁজেছে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। সে সময় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, ‘টাঙ্গাইলে কৃষকের ধানের জমিতে আগুন দেওয়ার যে ছবি মিডিয়ায় এসেছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। আগুন লাগিয়ে দেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ কৃষকের ওই আগুন লাগানোর ঘটনাটি বাংলাদেশের নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। সুতরাং কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরদের এসব প্রতিবাদ ছুঁতে পারেনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮’ অনুসারে, অতি ধনী বা ধনকুবেরের (৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৫২ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে এমন ব্যক্তি) সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশে বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে দেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ হারে। এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি। একই প্রতিষ্ঠানের করা আরেকটি প্রতিবেদন ‘গ্লোবাল এইচএনডব্লিউ অ্যানালাইসিস : দ্য হাই নেট ওর্থ হ্যান্ডবুক’ অনুসারে, ধনী (১০ লাখ থেকে ৩ কোটি মার্কিন ডলার বা সাড়ে ৮ কোটি থেকে ২৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক) মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে, বিশ্বে তৃতীয়। অন্যদিকে বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। বিপরীতে একই সময় সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে ৫৯ শতাংশ। এ থেকে স্পষ্ট, দেশে এক-শ্রেণির মানুষ উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে। ঠিক একই সময়ে এই উন্নয়নের চাপে পিষ্ট হচ্ছে আরেকটি শ্রেণি।   

সম্প্রতি পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির পর তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে যেসব মন্তব্য এসেছে তা দেশের খেটে-খাওয়া মানুষের সঙ্গে নিতান্তই রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। কেজিপ্রতি ১৫০ টাকা বিমান ভাড়া দিয়ে পেঁয়াজ আনার বিষয় নিয়ে গর্ব করতে দেখা গেছে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে। যদিও এসব কিছুর পরও দাম ১০ পয়সাও কমানো সম্ভব হয়নি। তার কথায় মনে হয়েছে, জনগণের ট্যাক্সের টাকা নয় তিনি তার ব্যক্তিগত অর্থে পেঁয়াজ আমদানি করেছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দাবি করেছেন, ‘চাল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মানুষের কোনো অসন্তোষ নেই।’ কারণ হিসেবে তিনি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। প্রায় ৮ গুণ বা কেজিপ্রতি দুইশ টাকার ওপরে বৃদ্ধি পাওয়া পেঁয়াজ বা কেজিপ্রতি ৬-৮ টাকা বৃদ্ধি পাওয়া চালের দাম নিয়ে মানুষের অসন্তোষ থাকবে না—এটা একজন মন্ত্রী কীভাবে ভাবতে পারেন তা আমাদের অজানা। সরকারি সংস্থা বিবিএসের তথ্যের দিকে তাকালে মন্ত্রী বুঝতে পারবেন দেশের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মাথাপিছু আয় বা ক্রয়ক্ষমতা বাড়লেও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের আয় বা ক্রয়ক্ষমতা বরং হ্রাস পেয়েছে।  

দেশে মেট্রোরেল হচ্ছে, মহাসড়কগুলো দুই লেন থেকে চার লেন, চার লেন থেকে ছয় লেনে উন্নীত হচ্ছে, নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ হচ্ছে, হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন ফ্লাইওভার, রেললাইন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে প্রায় ৫-১০ গুণ বেশি খরচে নির্মিত হচ্ছে প্রত্যেকটি উন্নয়ন প্রকল্প। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ যা গত সেপ্টেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকায়। যদিও এর সঙ্গে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ যোগ করলে সংখ্যাটা দ্বিগুণ হবে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশ থেকে পাচার হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাড়ছে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত। দেশে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের কারণে এক-শ্রেণির মানুষের পকেটে চলে যাচ্ছে উন্নয়নের ফসল। দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ—যাদের ঘামে, পরিশ্রমে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি তারাই পাচ্ছে না উন্নয়নের সুফল।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে ‘মুজিববর্ষ’ উদ্‌যাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত নগরসজ্জা থেকে শুরু করে স্মারকগ্রন্থ, কর্মশালা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে পাটকল শ্রমিকদের ঘামের মূল্য, বকেয়া বেতন পরিশোধ না করে নিজের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতেন না—একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

এ মাসের শুরুতে বেতন-ভাতা বাড়ানোসহ ১১ দফা দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট করেন নৌযান শ্রমিকরা। পরবর্তী সময়ে দাবি পূরণের আশ্বাসে জনগণের ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে এখনো কোনো দাবিই মেনে নেওয়া হয়নি। হয়তো দাবি আদায়ের তাগিদে তারাও একসময় আমরণ অনশনের ডাক দেবেন। হয়তো কোনো আবদুস সাত্তার জীবন দেবেন। কিন্তু তাতে টনক নড়বে না রাষ্ট্রযন্ত্রের। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না, দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ আছে বলেই একটা শ্রেণি উপরতলায় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে, দেশ উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে পারে। একজন আবদুস সাত্তারের মৃত্যু দেশের সাধারণ মানুষের অধিকারের বর্তমান অবস্থার চিত্রই আরো একবার আমাদের সামনে তুলে এনেছে। উন্নয়নের মহাসড়কে এই ক্ষুধার্ত শ্রমিকের লাশের ভার কি বইতে পারব আমরা? তার আত্মত্যাগের বিনিময়েও যদি দেশের মেহনতি মানুষের অধিকার, ন্যায্য দাবি আদায় হয়, তাতে তার ত্যাগের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান জানানো হবে।

লেখক : অ্যাক্টিভিস্ট, সমাজ বিশ্লেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!